রবিবার ● ১৪ এপ্রিল ২০২৪
প্রথম পাতা » চট্টগ্রাম » ‘বৈসাবি’ কে ঘিরে পাহাড়ি পল্লীতে উৎসবের আমেজ
‘বৈসাবি’ কে ঘিরে পাহাড়ি পল্লীতে উৎসবের আমেজ
পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের প্রধান সামাজিক উৎসব ‘বৈসাবি’। গেল ২০২১ ও ২২ সালে করোনা ভাইরাস সংক্রমনের কারণে এ উৎসব উৎসাহ উদ্দীপনায় পালন করতে পারেনি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিরা। এ বছর পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকায় উৎসবকে ঘিরে পাহাড়ি পল্লীগুলো সেজেছে নতুন সাজে, ঘরে ঘরে শুরু হয়েছে উৎসবের আমেজ। আনন্দে মাতোয়ারা বান্দরবান জেলার লামা উপজেলার প্রত্যন্ত পাহাড়ি পল্লীগুলো।
১৪ এপ্রিল, রবিবার সকালে ক্যায়াং দর্শন ও সমবেত প্রার্থনার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এ উৎসব শুরু হয়। কেন্দ্রীয়ভাবে উপজেলার একটি পৌরসভা এলাকাসহ ইউনিয়ন পর্যায়ে পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টি সম্প্রদায়ের পাড়াগুলোর বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠন, ক্লাব, সমিতির উদ্যোগে সাংগ্রাইং পোয়ে জলকেলি উৎসব পৃথকভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বলে জানান আয়োজক কমিটি।
১৪ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে ২০ এপ্রিল শনিবার লামা সদর ইউনিয়নের মেরাখোলা মার্মা পাড়ার পানি খেলার মধ্য দিয়ে শেষ হবে এ উৎসব।
জানা গেছে, লামা উপজেরার একটি পৌরসভা ও ৭টি ইউনিয়নের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টি চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা সম্প্রদায় বর্ষবরণকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হিসেবে পালন করে থাকেন। ১৯৮৫ সাল থেকে পাহাড়ে বসবাসরত বিভিন্ন সংগঠনের সম্মিলিত উদ্যোগে ‘বৈসাবি’ নামে এ উৎসব পালন করে আসছেন। যা সময়ের ব্যবধানে নিজ নিজ সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে ‘বৈসাবি’ হিসেবেই জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এ উৎসবকে সামনে রেখে উপজেলাগুলোর হাট-বাজারে কেনা-কাটা ধুম পড়েছে। বিপনী বিতানগুলোতে পাহাড়ি তরুন-তরুনীদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষনীয়।
বর্ষবরণ ও বিদায় উপলক্ষ্যে ত্রিপুরা সম্প্রদায় ‘বৈসুক’, মারমা সম্প্রদায় ‘সাংগ্রাই’ এবং চাকমা সম্প্রদায় ‘বিজু’ নামে এ উৎসব পালন করে থাকেন। একত্রে ৩টি আদ্যাক্ষর নিয়ে বৈ-সা-বি বলে পাহাড়ে এই উৎসব পরিচিত।
চৈত্রের শেষ দিনের আগের দিনকে বলা হয় ফুল বিজু। এদিনে ফুল দিয়ে ঘরবাড়ি সাজানো হয়। দ্বিতীয় দিন চৈত্র সংক্রান্ত ‘বৈসাবি’ অথবা মূল বিজু। এদিনকে উৎসবের প্রধান দিন ধরে নেয় চাকমারা। ত্রিপুরা ও মারমারা এদিন পালন করলেও তাদের জন্য ১ বৈশাখ হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ দিন।
মূল বিজুর সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে ‘পাচন’ (অনেক রকমের শাক-সবজি, ফল মুলের সমন্বয়ে রান্না করা তরকারি)। এই পাচনে যে যত পদের সবজি মেশাতে পারবে তার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। এদিন নতুন কাপড় পরে বাড়ি বাড়ি বেড়ানো, পাজন খাওয়া চাকমাদের আনন্দ উদ্যাপনের মূল আয়োজন। চাকমাদের মধ্যে প্রচলিত আছে যে, বিজুর দিন কমপক্ষে পাঁচ বাড়িতে বেড়াতে হবে। এসব বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে পাজন খেলে পরবর্তী ৩ মাস কোন রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হবেনা কেউ। পাচনের সঙ্গে ভাত থেকে তৈরি পানীয় অর্থাৎ দো-চুয়ানী (বাংলা মদ)। এই দো-চুয়ানী ছাড়া চাকমা সমাজে বিজু, বিয়ের অনুষ্ঠান কখনও সম্পন্ন হয়না। এই রীতি এখানে প্রচলিত। আর এই দিন বাংলা মদ খেতে কোন বাধা নেই। খাও দাও অনাবিল আনন্দে মেতে ওঠে, এটাই রীতি।
ত্রিপুরা সম্প্রদায় এদিন উদ্যাপন করে তাদের ঐতিহ্যবাহী বিশেষ নাচের মাধ্যমে। যার নাম ‘গড়াইয়্যা নৃত্য’। নারী পুরুষ সবাই এক সঙ্গে নাচে। এ নাচের বিশেষত্ব হচ্ছে, যে বাড়ি থেকে এ নাচ শুরু হবে সে বাড়িতেই এসে নাচ শেষ করতে হবে। ত্রিপুরাদের এই উৎসবকে ‘বৈসুক’ বলে।
মারমা সম্প্রদায় ১ বৈশাখ পালন করে বর্ণিল জলকেলি বা পানি উৎসবের মধ্য দিয়ে। পুরনো বছরের সব দুঃখ হতাশাকে মুছে ফেলার জন্য জল ছিটানো উৎসব (পানি খেলা)। যা মারমা সম্প্রদায়ের ‘সাংগ্রাই’ উৎসব নামে পরিচিত। অবশ্য আধুনিকতার ছোঁয়ায় চাকমাদের সাংগ্রাই উৎসবের নাম এখন ‘ওয়াটার ফেষ্টিভ্যাল’ রাখা হয়েছে। নারী-পুরুষ মারমা গানের তালে তালে একে অপরকে পানি ছিটিয়ে একে অপরকে জলে টুইটুম্বুর করে ভেজানোর প্রতিযোগিতা করেন। এই জলকেলির মাধ্যমে মারমা তরুন-তরুনী একে অপরের মাঝে ভালোবাসার বিনিময় হয়। একইভাবে ত্রিপুরা, বম, পাংখোয়া সম্প্রদায়গুলোও সাংস্কৃতিক অনুষ্টান ও নিজস্ব খাবারের আয়োজন করে এ উৎসবে।
শুধু তাই নয়, এ বৈসাবি উৎসবকে ঘিরে পাড়ায় পাড়ায় নানা খেলা-ধুলারও রয়েছে ঘিলাখেলা, নাদেরখেলা, বলিখেলা, ফোরখেলা, পুত্তিখেলা ও তুমুরো খেলা এবং তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উপরে উঠা খেলারও আয়োজন করা হয়। আয়োজক ও জনপ্রতিনিধিদের মতে এবারে পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুকূলে থাকায় উৎসব মুখর পরিবেশে ‘বৈসাবি’ পালন করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে লামাা উপজেলার গজালিয়া ইউনিয়নের গাইন্দ্যা পাড়া উৎসব পরিচালনা কমিটিরি আহবায়ক মংক্যহ্লা মার্মা জানান, এ বছর উৎসবের দিনগুলোতে বড় পরিসরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও পানি খেলার আয়োজন করা হয়েছে। এ অনুষ্ঠানে পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপির সহধর্মিনী মেহ্লাপ্রু উপস্থিত থাকবেন।
এদিকে উপজেলার কেন্দ্রীয় ‘বৈসাবি’ উৎসব উদ্যাপন কমিটির আহবায়ক অংচাইন ওয়াং ও সদস্য সচিব যতিন মার্মা বলেন, গেল ২০২১ ও ২২ সালে করোনা ভাইরাসের কারণে উৎসাহ উদ্দীপনায় উৎসব পালন করা যায়নি। গত বছর থেকে পরিস্থিতি স্বাবাভিক হওযার কারণে উৎসব মখুর পরিবেশে পালনের আয়োজন করা হয়।
তারা বলেন, বৈসাবিকে সামনে রেখে ৭ দিনের বর্ণাঢ্য কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে পাড়ায় পাড়ায় ক্যয়াং দর্শন ও সমবেত প্রার্থনা, দড়ি টানাটানি, হাড়ি ভাঙ্গা, পিঠা তৈরি, ঐতিহ্যবাহী তৈলাক্ত বাঁশ আহরণ, পানি খেলা, সাংস্কৃতিক ও পুণর্মিলনী অনুষ্ঠান।
এ বিষয়ে লামা থানা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ মো. শামীম শেখ বলেন, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিরা যাতে ‘বৈসাবি’ উৎসব শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুূখর ভাবে পালন করতে পারেন, সেজন্য বৌদ্ধ কেয়াং ও পাড়াগুলোতে সাদা পোশাক ও পোশাকধারী পুলিশ মোতায়েনসহ বিশেষ নজরদারীতে রাখা হয়েছে।
বিষয়: #পল্লী #পাহাড়ি #বৈসাবি