শুক্রবার ● ৮ মার্চ ২০২৪
প্রথম পাতা » অনুপ্রেরণা (গল্প) » #সে_আমার_সোনালী
#সে_আমার_সোনালী
ফুফাতো বোনের সঙ্গে এক বেডরুমে রাত কা’টায় সকাল গোসল করে নাস্তা নিয়ে আসে? এসব তো ঘরের বউয়ের কাজ তাহলে এগুলো কেনো আপনার ফুফাতো বোন করে? এর কারণ কি? এই যে এখনো আপনার শার্ট পরে সে ঘোরাঘুরি করছে?কেনো?নাটক করেন আমার সাথে? নাটক! আপনার ফুফাতো বোনদের আমি চিনি না?হ্যা?চিনি না?” এক নিঃশ্বাসে বললো নবনী।
পরনের বোরকাটিও এখনো খুলেনি সে। কিছুক্ষণ আগেই সাইফুলকে সারপ্রাইজ দিতে ঢাকা থেকে এখানে এসেছে সে। কিন্তু এতদূর থেকে এসে এসব দেখা মাত্র সব ল’ন্ডভ’ন্ড হয়ে গিয়েছে। একই কথা বারবার আওড়াচ্ছে। সাইফুল অচেনা মেয়েটিকে ফুফাতো বোন পরিচয় করিয়ে দেওয়া মাত্রই নবনীর মষ্তিষ্ক আরো বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। কোনো সাফাই না শুনেই প্রশ্নগুলো করলো। কথা শেষ করেই টের পেলো তার সম্পূর্ণ শরীর কাঁপছে। মাথাটাও হালকা চক্কর দিয়ে উঠেছে। সাইফুল তাকে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে দুদিক থেকে ধরে ফেললো। তৎক্ষণাৎ গা ঝাঁড়া দিয়ে তাদের সরিয়ে দিয়ে নিজেকে সামলালো নবনী।
-” ছোঁবে না আমায়, ছোঁবে না।” বিরবির করে বললো।
-” নব, শুনো তুমি যা দেখছো তা ঠিক নয়। আমাদের মধ্যে এমন কিছুই নেই। তোমার দিব্যি।” হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে সাইফুল বললো।
-” ঠিক বেঠিক আমি দেখতে পাচ্ছি।”
-” না তুমি পাচ্ছো না। চোখের দেখা সবসময় ঠিক হয় না। তুমি ভুল বুঝতেছো। তুমি যা দেখছো তা সবটা মুদ্রার এপিঠ। মুদ্রার ওপিঠ তোমার জানা নেই। তুমি বুঝতে পারছো?”
নবনী কঠিন গলায় বললো,
-” একদম চেঁচাবেনা। মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ দুটোই আমার জানা। আমার অনুপস্থিতে অন্য নারীর কাছে যেয়ে বলছেন আমি ভুল? আমাকে ঠকিয়েছেন আপনি। ঠকিয়েছেন।”
সাইফুল তার চোখের দিকে তাকালো। আ’হত, ক্ষ’ত-বি’ক্ষত দৃষ্টি। নবনী আনমনে বিছানার উপর বসে পড়লো। মষ্তিষ্কের নিউরনগুলো ঠিকঠাক কাজ করছে না। সাইফুলকে সে ভালোবাসাে।ভীষণ ভালোবাসে। আর ভালোবাসার উপর এতটুকু বিশ্বাস রয়েছে যে সাইফুল এমন কিছু করবে না।কিন্তু সব তো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। তাকে বিভ্রান্ত দেখালো। মন আর মষ্তিষ্কের মধ্যে বড়সড় বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেলো। নবনী জানে এ যুদ্ধে তার মন জিতবে। কারণ সে সাইফুলের উপর দূর্বল। ভীষণ দূর্বল। সাইফুল হাটুগেড়ে নবনীর সামনে বসে পড়লো। নবনীর ডান হাত টেনে তার দুইহাতে আবদ্ধ করে বললো, -” নব,ইউ ট্রাস্ট মি,রাইট?”
নবনী চোখ বন্ধ করে ফেললো। বড়বড় নিঃশ্বাস নিতে লাগলো।মিনিট দুয়েক নিশ্চুপ থেকে শান্ত কন্ঠে বললো, -” ওকে এক্ষুণি চলে যেতো বলো।”
সাইফুল থমথমে মুখে ফর্সা বর্ণের মেয়েটির দিকে একপলক তাকালো।এ কথা বলতে পারবে না সে। চুপ থাকতে দেখে নবনী ফের বললো, -” কি হলো বলছো না কেনো?”
সাইফুল চুপ করে রইলো। এ মুহূর্তে নবনীকে কোনো উপক্রমেই সে বুঝাতে পারবে না এ বিষয় ভালো করে জানা তার। উল্টো বিগড়ে যাবে সব। চুপ থাকাটাকেই বেস্ট অপশন হিসেবে মনোনীত করে নিলো।
-”কারণ টা কি জানতে পারি?” নবনী বিদ্রুপের সুরে বললো।
-” না।”
এ পর্যায়ে সাইফুল মুখ খুললো। তারপর ঠিক আগের মতো নিস্তব্ধতা। নবনী সাইফুলের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। সেই দৃষ্টিতে একটা শব্দও উচ্চারণ না করে শত শত কথা বলে ফেলছে দুজনে।না আছে কোনো সাড়া না আছে শব্দ। সবকিছুই নিস্তব্ধ। আকাশ আবারো অন্ধকার হতে লাগলো। বাতাসের গতিবেগ কিছুক্ষণ বাদে প্রখর গতিতে ছুটলো। থেকে থেকে জানালার ধারে বিজলি চমকাতে লাগলো। সো’নালী আলোয় উজ্জ্বল হতে লাগলো তিনটি মুখ। সবকিছুই থমকে রয়েছে। কেউ একজন যেনো ইশারায় থামিয়ে রেখেছে। এভাবে কত মুহূর্ত কে*টে গেলো কেউই টের পেলো না। টনক নড়লো তখন যখন বিছানার উপরের ফোনটি বেজে উঠলো। সাইফুল হাত বাড়িয়ে নেওয়ার পূর্বেই নিরা ফোন তুলে নিলো। ফোন তুলেই বললো,-” এক্ষুণি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন। এক্ষুণি।” ওপাশ থেকে কি বললো শোনা গেলো না। নিরা আবারো একই কথা বললো। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে সাইফুলের দিকে ফোন এগিয়ে দিলো। সাইফুল নবনীর দিকে এক পলক তাকিয়ে ফোনটি হাতে নিতেই নিরা দ্রুতগতিতে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো। সাইফুল ফোনের স্পীকার অন করতেই অপাশ থেকে ভারী কন্ঠে পুরুষালী আওয়াজ আসলো,
-” সাইফুল!সাইফুল! এসব কি শুনছি? নিরা তোমার কাছ থেকে চলে আসতে চাইছে?কিন্তু কেনো?”
-” চলে যেতে চাইলে যাবে। আমি কি করবো?”
-” সাইফুল ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া হু ইজ সি?”
-” জানতে চাই না স্যার। ব্যাস এটুকুই জানি আমার সাথে রাখতে পারবো না।” স্লান গলায় বললো সাইফুল।
জামাল সাহেব শান্ত কন্ঠে বললো,
-” সাইফুল, এসব অ’যৌক্তিক কথা আমাকে বলবা না।
তোমাকে ওখানে এমনি এমনি নিশ্চই পাঠানো হয় নি! মিস নিরার কিছু হলে কি হতে পারে নিশ্চই জানা আছে। একটা কথা মনে রাখবা সাইফুল, মিস নিরার ফুল প্রো*টেকশন তোমার দায়িত্ব। উনার কিছু হলে তোমার সাথে সাথে আমাদেরও….”
মাঝপথেই সাইফুল ফোন কে*টে দিলো। মুখ দিয়ে বাজে শব্দ উচ্চারণ করে মোবাইল ফোনটি বিছানার উপর ছুঁড়ে মা*রলো। ঠিক সেসময়ে বিকট আওয়াজ আসলো। সাথে ভেসে আসলো তীব্র চিৎকার। সাইফুল হন্তদন্ত হয়ে শব্দের উৎসের দিকে ছুটলো।নবনীও পেছন পেছন এগোলো। মাঝপথেই সাইফুলের উল্টোদিক অর্থাৎ ব্যালকনির দিক থেকে ছুটতে ছুটতে সাইফুলের সাথে ধাক্কা খেলো নিরা। পড়ে যাবার আগেই তাকে ধরে ফেললো সাইফুল। তৎক্ষণাৎ শ’শব্দে কেঁদে দিলো সে।
-” কি হয়েছে নিরা? আপনি চিৎকার দিয়েছেন কেনো?একি আপনি কাঁদছেন! কিন্তু কাঁদছেন কেনো?” সাইফুল বললো।
-” ওরা এসে গেছে। মে*রে ফেলবে। র*ক্ত।” নিরা এদিক- ওদিক তাকিয়ে বলতে বলতে বাম হাতের দিকে চোখ পড়তেই চুপ করে গেলো। ঠিক কব্জির দু ইঞ্চি উপর থেকে ব্ল্যা*ড বের হচ্ছে। যার একটু পাশেই বিশেষ চিহৃ ট্যাটু করা।
-” নিরা একদম প্যানিক হবেন না। কিচ্ছু হয় নি আপনার। রিলেক্স! নবনী নবনী! এদিকে আসো। উনার হাত থেকে এক্ষুণি বুলেট বের করো।”
-” বুলেট নেই।”
-” কি বলছেন আপনি? বুলেট নেই? বুলেট না বের করলে আপনি মারা যাবেন।” নবনী অবাক হয়ে বললো।
-” না। বু*লেট ছুঁয়ে বের হয়ে গিয়েছে। সে এসব প্ল্যান করেই এট্যাক করেছে। আর আমি জানি, এটা আমার জন্য ওয়ার্নিং ছিলো। সে এবার আর আমাকে ছাড়বে না। আমি বলেছি না, আপনি কোথাও আমাকে লুকাতে পারবেন না। দুনিয়ার যেখানে নিয়ে যান না কেনো সে সেকেন্ডেই আমাকে বের করে ফেলবে। দেখেছেন তো?এখন কি হবে? ছাড়বে না। আপনাকেও ছাড়বে না। সিংহের খাঁচায় হাত দিয়েছেন আপনি। আপনার মৃ*ত্যু নিশ্চিত। কি হবে এখন?কি হবে?”
কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে সেন্সলেস হয়ে গেলো নিরা। অনিচ্ছা স্বত্তেও নবনী এগিয়ে এসে তাকে ধরে ফেললো। কারণ সে একজন ডক্টর। আর তার সবচেয়ে বড় ধর্ম রোগীকে সুস্থ করা। নবনী প্রায় সবসময় হ্যান্ডব্যাগে ফার্স্ট এইড বক্সে সরঞ্জাম বহন করে। তবে তার আজকের ব্যাগটি সম্পূর্ণ নতুন। সে মনে করতে পারলো না যন্ত্রপাতি রেখেছিলো কি না। এলোমেলো পা ফেলে এগিয়ে গেলো ব্যাগের দিকে। চেইন খুলতে খুলতে আবারো নিরার কাছে ফিরে আসলো। ব্যাগে হাত দিয়েই সে চমকে উঠলো। বিষ্ময়কর আওয়াজ করতেই সাইফুল তার দিকে লক্ষ্য করলো। ব্যালকনির চক্কর কে*টে এসেছে সে। দূর্ভাগ্যবশত কারো কোনো হদিস পায়নি।
-” কি হয়েছে নব? তুমি চেঁচালে কেনো? মিস নিরার কিছু হয় নি তো?” হড়বড়িয়ে বললো সাইফুল।
-” না, ঠিক আছে।” একটু দম নিয়ে নবনী ফের বললো, কিন্তু আমার ব্যাগে! ব্যাগে সিজার,তুলো,মেডিসিন সব সব আছে। কিন্তু এগুলো আমি তো রাখি নি। রাখি নি। কে রেখেছে এগুলো?কে? কেনো রেখেছে? কাগজ! এটা কিসের কাগজ?কে রেখেছে?” নবনী অস্থির হয়ে উঠলো। সাইফুল বললো,-” কি লেখা আছে? আগে সেটা পড়ো।”
কালার পেপারের ভাঁজ খুলেই নবনী লেখাটি হুবহু পড়তে লাগলো।
-’ডক্টর নবনী, আপনি আমার একসময় অজান্তেই খুব বড় একটা উপকার করেছিলেন। আমি উপকারীর উপকার কখনো ভুলি না। সে কারণে আপনার মিস্টারকে ছেড়ে দিলাম। তবে সে যে সাহস দেখিয়েছে তার প্রাপ্য অবশ্যই পেয়ে যাবে। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই। এরপরেও যদি দ্বিতীয়বার সে আমার নিরুপাখির আশেপাশে আসে আই সোয়্যার জিন্দা ক*বরে দা*ফন করে দিবো। তাই ফেরার সময় তাকে নিয়ে যাবেন। নাহলে আর কোনোদিন স্বামীর চেহারা কেনো ছায়াও দেখতে পারবেন না। হারিয়ে ফেলবেন তাকে।এটা আমার প্রথম ওয়ার্নীং। এবার শুনুন,আপনার পার্সে ব্লু কালার বোতলে একটি বিশেষ মেডিসিন রয়েছে। সেটা দিয়ে নিরুপাখির হাত টা আগে ভালো করে পরিষ্কার করে নিবেন। বাকি তো আপনি জানেনই। বাট, বি কেয়ারফুল! নিরুপাখির হাতের চিহ্ন যেনো অক্ষত থাকে। আর এটা আমার সেকেন্ড ওয়ার্নীং।’
চিরকুট পড়েই নবনী কাঁপতে লাগলো। শরীর কেমন ভার ভার লাগছে, মাথায় ঝিমঝিম শুরু হয়ে গেলো। সাইফুল ছোঁ মেরে কাগজটি নিয়ে দেখতে লাগলো। রাগে কপালের রগ ফুলে উঠলো। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে চিরকুট ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেললো।
-” রিডিকুলাস! ফালতু কথা। সিক পারসন! লোকটা নিশ্চিত মেন্টালি সিক! শুনো নব, শুধু তার প্রতি মানুষের ভয় ক্রিয়েট করতে এসব করছে সে। এদের বলে এটেনশন সিকার! তুমি বুঝতে পারছো? হ্যা? এগুলোতে একদম কান দিবা না। তুমি এক্ষুণি মিস নিরার সার্জারী করো। কুইক।” কঠিন গলায় বললো সাইফুল।
-”কিন্তু….”
-” তোমাকে সব বলবো নবনী। তুমি প্লিজ আগে উনার চিকিৎসা করো।” আশ্বাস দিয়ে বললো সাইফুল।
নবনী পাথরের মতো নিরার হাতের চিকিৎসা করতে লাগলো। গুলি করার কারণে হাতের অংশটি ছিঁলে গেছে, তবে বুলেট রয়ে যায় নি। নিরা ঠিকই বলেছে। হাত থেকে প্রচুর রক্ত বেরিয়েছে, সম্ভবত র*ক্ত লাগতে পারে। নবনীর মাথা আবারো চক্কর দিয়ে উঠলো।কত ডেঞ্জেরাস লোক! জেনেশুনে আ’ক্রমণ করে। আকাশ পাতাল চিন্তা করতে করতে প্রায় আধ ঘন্টার মতো লেগে গেলো ড্রেসিং করতে। নিরা তখনও সে-ন্সলেস। ড্রেসিং কমপ্লিট হতেই নবনী হঠাৎ তাকিয়ে দেখলো সাইফুল কক্ষে নেই। মুহূর্তেই থমকে গেলো সে। দ্রুত পায়ে ছুট লাগালো সাইফুলের উদ্দেশ্য। নবনী বাহিরে এসে দেখলো সাইফুল প্রায় বিশ-ত্রিশ জন পুলিশের সাথে কথা বলছে। জানে জান ফিরে আসলো। কিন্তু পুলিশ কেনো? তাদের দেখেই কৌতুহল জেগে উঠলো মন-মষ্তিষ্কে। নবনী সাধারণত কোনো বিষয়ে কৌতুহল জমলেও আগ্রহ দেখায় না। কিন্তু এবার তার কৌতুহল থেকেও আগ্রহ বেশি দেখা দিলো। ধীর পায়ে সাইফুলের দিকে এগিয়ে গেলো সে। কিন্তু কয়েক কদম এগোতেই এমন কিছু ঘটলো যার জন্য নবনী একদম প্রস্তুত ছিলো না। একদম না। এক সেকেন্ডের জন্য মনে হলো পায়ের তলার মাটি সরে গিয়েছে। নবনী প্রাণপণ আওয়াজ দিয়ে ডাক দিলো, “সাইফুলল……….
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত