রবিবার ● ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩
প্রথম পাতা » অনুপ্রেরণা (গল্প) » “সাবিহার গল্প”
“সাবিহার গল্প”
বিয়ের কিছুদিন পরই সাবিহা বুঝতে পারলো তার সরকারি চাকরি করা স্বামী জাবেদ ঘুষ খায়।
ব্যাপারটা জানার পর সে জাবেদকে বললো,”বিনীত অনুরোধ করছি, ঘুষ নেয়া ছেড়ে দাও।”
জাবেদ বললো,”এটাকে ঘুষ বলে না। এটা হলো বকশিস। হাদিয়া। স্পীড মানি।”
“ঘুষকে অন্য নামে ডাকলে ঘুষ হালাল হয়ে যায় না। ঘুষ হলো হারাম। আর নবীজী বলেছেন, হারাম দ্বারা গঠিত শরীর জান্নাতে প্রবেশ করবে না। অর্থাৎ জাহান্নামে যাবে।”
বিরক্ত হয়ে জাবেদ বললো,”ওয়াজ শুরু করেছো নাকি? ওয়াজ শোনার সময় নাই এখন।”
এই বলে জাবেদ রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
সাবিহা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
আরেকদিন সাবিহা বললো,”তুমি যখন কারো কাছ থেকে ঘুষ দাবি করো, তখন কেউ কিন্তু তোমাকে আনন্দ নিয়ে ঘুষ দেয় না। তারা বাধ্য হয়ে তোমাকে ঘুষ দেয়। আর দেয়ার সময় মনে মনে তোমাকে অভিশাপ দেয়, বদদোয়া দেয়। আর এই অভিশাপ, বদদোয়া তোমার জীবনে ভালো কিছু বয়ে আনবে না।”
জাবেদ রেগে গিয়ে বললো,”এই প্রসঙ্গে আর কথা শুনতে চাই না।”
সাবিহা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
জাবেদ লক্ষ্য করলো, সে যদি সাবিহার জন্য দামী জামা কাপড় কিনে আনে সাবিহা সেগুলো পরে না।
এর কারণ জানতে চাইলে সাবিহা বললো,”তুমি যে টাকা বেতন পাও তাতে এতো দামী পোশাক কেনার সামর্থ্য তোমার থাকার কথা নয়। ভালো করেই জানি কোন টাকা দিয়ে তুমি এই পোশাক কিনেছো।”
তারপর বললো,”তোমাকে আমি আগেও বলেছি এখনো বলছি, ঘুষের টাকায় কেনা কোনো কিছু আমি স্পর্শ করবো না।”
জাবেদ বিদ্রূপ করে বললো,”যত্তোসব!”
সাবিহার ঘুষের টাকা স্পর্শ না করার ফলে অধিকাংশ দিন ঘরে রান্না হয় সবজি দিয়ে। সপ্তাহে একদিন অর্থাৎ শুক্রবার রান্না হয় মাছ কিংবা মাংস। কারণ জাবেদের বেতনের টাকা দিয়ে প্রতিদিন মাছ, মাংস রান্না করা যায় না।
এদিকে জাবেদ খেতে বসে ক্রোধের সাথে বললো,”এতো টাকা কামিয়ে আমাকে সবজি দিয়ে ভাত খেতে হবে? এটা কি তামাশা?”
সাবিহা উত্তরে বললো,”হারাম টাকা দিয়ে কেনা কোনো কিছু আমি রাঁধবো না।”
“ঠিক আছে। তোমার সবজি তুমি খাও।”
এরপর জাবেদ একজন বুয়া ঠিক করলো তাকে রেঁধে দেয়ার জন্য।
সময় গড়াতে লাগলো। এর মধ্যে তাদের দুটো ছেলে সন্তান হলো।
বড়ো ছেলের বয়স যখন পাঁচ বছর হলো তখন একদিন বাবার সাথে বাইকে করে ঘুরতে যাওয়ার সময় সড়ক দুর্ঘটনায় ছেলেটি মারা গেলো। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে জাবেদের তেমন কিছু হলো না।
মৃত ছেলের জামা বুকে আঁকড়ে ধরে শোকতপ্ত কণ্ঠে সাবিহা জাবেদকে বললো,”প্লিজ, ঘুষ নেয়া ছেড়ে দাও।”
জাবেদ ক্ষেপে গিয়ে বললো,”তোমার কি ধারণা, ঘুষ নিই বলে এক্সিডেন্ট হয়েছে? দুনিয়ার মানুষ দুর্নীতি করে ভালো আছে। শুধু আমার একা বিপদ হবে? এসব উল্টাপাল্টা কথা বোঝাতে এসো না। ছেলের মৃত্যুতে আমি কম কষ্ট পাই নি।”
সাবিহা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
এর বছর খানিক পর তাদের ছোটো ছেলেটা যার বয়স তিন বছর, সে এক রাতে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লো।
হাসপাতালে ভর্তি করার পর সাবিহা জাবেদকে মিনতি করে বললো,”ঘুষের টাকায় ছেলের চিকিৎসা করিও না। ওর চিকিৎসার খরচ আমি দেবো।”
জাবেদ তাচ্ছিল্যের সাথে বললো,”তুমি কোত্থেকে দেবে?”
“পৈতৃক সম্পত্তি থেকে যে জমি পেয়েছি তা বিক্রি করবো।”
জাবেদ সাবিহার কথা শোনে নি। সে দু হাতে ঘুষের টাকা ঢালতে লাগলো ছেলের জন্য। কিন্তু ছেলে সুস্থ হলো না। বরঞ্চ অবস্থা খারাপ হতে লাগলো।
তখন জাবেদ নিচু স্বরে সাবিহাকে একদিন বললো,”জমিটা তবে বিক্রি করো।”
সেই জমি বেচা টাকা দিয়ে ছোটো ছেলের চিকিৎসা আরম্ভ হলো। এবং অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি ছেলেটা এবার সুস্থ হয়ে উঠলো।
জাবেদ হতবাক হয়ে গেলো।
সেদিন সে সাবিহাকে বললো,”আর কোনোদিন ঘুষ নেবো না।”
সাবিহা সঙ্গে সঙ্গে জাবেদকে জড়িয়ে ধরলো। ভালোবাসায়।
২.
পঁচিশ বছর পর ছোটো ছেলেটি যখন সরকারি চাকরিতে ঢুকলো তখন জাবেদ ছেলেকে বললো,”ঘুষ খেয়ে বিলাসী জীবন কাটানো যায়। কিন্তু মনে রাখবি, সেই বিলাসী জীবনের সাথে মিশে থাকে মানুষের মন:কষ্ট, অভিশাপ এবং বদদোয়া। আর এমন অভিশপ্ত জীবন নিয়ে কেউ সুখী হতে পারে না। আমি কি বলতে চাচ্ছি আশা করি তুই বুঝতে পেরেছিস?”
ছেলে বললো,”বুঝতে পেরেছি বাবা। আর মায়ের কবরের কাছে এলে এই কথাগুলো আরো বেশি করে বুঝতে পারি।”
হ্যাঁ, তিন বছর হলো সাবিহা মারা গেছে।
জাবেদ এরপর বললো,”আমি যখন ঘুষের টাকায় দিনের পর দিন ভালো খাচ্ছিলাম, ভালো পরছিলাম, আর তোর মার সততার জন্য তাকে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করছিলাম, সে তখন কেবলমাত্র আমার বেতনের টাকা দিয়ে সাধারণ খাবার খেয়ে, সাধারণ পোশাক পরে থেকেছে, আর আমার সংশোধনের জন্য আমাকে বুঝিয়েছে আর দোয়া করেছে।”
বলতে বলতে জাবেদের চোখে পানি চলে এলো।
তারপর বললো,”আমি খুব ভাগ্যবান একজন মানুষ ছিলাম। তোর মাকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পেয়েছিলাম। আশ্চর্য সুন্দর মনের এই মেয়েটি আমার অন্ধকার জীবনটাকে আলোকিত করে দিয়েছিলো। তুইও খুব ভাগ্যবান। কারণ তার দোয়া তুইও পেয়েছিস।”
এরপর বললো,”আয়, বাপ ব্যাটা মিলে এবার তার জন্য দোয়া করি।”
অত:পর সাবিহার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে পিতা পুত্র ভেজা চোখে দোয়া করতে লাগলো।
“সাবিহার গল্প”
- রুদ্র আজাদ
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত
বিষয়: #গল্প #সাবিহা