বৃহস্পতিবার ● ৯ নভেম্বর ২০২৩
প্রথম পাতা » মতামত » পুলিশনামা
পুলিশনামা
মো. দিদারুল ফেরদৌস :
পুলিশে যোগ দেবার আগে আমি নিজেও অসংখ্য রঙিন স্বপ্নে বিভোর ছিলাম। পড়াশোনা যতটুকু করা দরকার সেটাও ঠিকঠাকই করেছি বলে মনে হয়। কিন্তু চাকরিতে যোগ দেবার পরপর একটা একটা লালিত স্বপ্ন বিষ মাখানো হতে লাগলো আমার।
একটি বছর সারদায় প্রশিক্ষণ কালের কথাই যদি বলি। দিনভর গাধার খাটুনির সাথে দৈনিক ২৩ টাকা বাজেটের খাবার তিন বেলার জন্য বরাদ্দকৃত। ভাবা যায়? জেলখানাতে কয়েদিদের জন্য দৈনিক বাজেট কি ২৩ টাকা? আপনারাই ভালো জানবেন। সারাদিন কঠোর পরিশ্রমের বেসিক ট্রেনিংয়ে থাকা টগবগে যুবকদের সকালে আর বিকেলের জন্য বরাদ্দ দুই পিস শক্ত হয়ে থাকা লাল রুটি। সাথে সেই রুটিতে মোড়ানো এক টেবিল চামচ শুকনো সবজি। দুপুরে ভাত, ডাল আর এক পিস মাছ দিয়ে শরীর চলে?
ফলে, প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীর বাড়ি থেকে টাকা আনিয়ে উপযুক্ত খাবারে ব্যবস্থা করতে হতো। প্রশিক্ষণকালে যত পোশাক, ইউনিফর্ম, বুট, বেল্ট, স্যুট, টাই- সবকিছুই নিজেদের কেনা। সরকারি কোন বরাদ্দ নেই! গোটা এক বছর সামর্থ্য ভেদে লক্ষাধিক টাকা এক একজনের ব্যয়।
প্রশিক্ষণ শেষে যেদিন প্রথম থানায় যোগ দেই। ভীষণ উচ্ছ্বাস নিয়ে। পাশে একখানা খালি টেবিল দেখে চেয়ারে গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ পরেই দেখি আরেকজন অফিসার এসে আমার পাশে উশখুশ করছেন। কিছুক্ষণ পরে উনি আমাকে বলেই বসলেন, ‘ভাই আমার জরুরী কিছু কাজ আছে, দূরের আরেকটা খালি চেয়ার দেখিয়ে বলেন, কিছু যদি মনে না করেন, ওখানে বসবেন, প্লিজ।’
আমি অপ্রস্তুত হয়ে কি করবো খানিক ভাবছিলাম। মনে মনে ভীষণ অপমানিত বোধ করছিলাম। কিন্তু উঠে গিয়ে ওই খালি চেয়ারটায় গিয়ে বসলাম। কিন্তু আরও কিছুক্ষণ পরে আরেকজন অফিসার এসে আমাকে একইভাবে উঠিয়ে দিলেন। অপমানে লজ্জায় সে রুম ছেড়ে দিয়ে ডিউটি অফিসারের কক্ষে দর্শনার্থীদের জন্য রাখা চেয়ারে বসলাম।
ডিউটি অফিসার র্যাংকে জুনিয়র। তিনি বোধ হয় আমার লজ্জায় রক্তিম হয়ে থাকা মুখটি দেখে কিছু আঁচ করেছিলেন। আমাকে আশ্বস্ত করে তিনি জানালেন, স্যার থানায় যত টেবিল, চেয়ার, ফাইল কেবিনেট দেখছেন সবই সংশ্লিষ্ট অফিসারদের পকেটের টাকায় কেনা। একটাও সরকারি টাকায় নয়। তাই, যার যার কেনা টেবিল চেয়ারে সে বসে। বদলি হয়ে অন্য কোন স্টেশনে গেলে সাথে নিজের কেনা টেবিল-চেয়ার, কেবিনেটসহ নিয়ে যায়!
এবার আসি, প্রথম মোবাইল ডিউটিতে যাবার কথায়। আমাকে একটা পাবলিক লেগুনা গাড়ি দেয়া হলো। সাথে চারজন পুলিশ। রাত ৮টা থেকে পরদিন সকাল ৮টা পর্যন্ত একটা এলাকায় টহল দিতে হবে। পুলিশ চারজন পেছনে গিয়ে বসলেন, আমি ড্রাইভারের পাশে। গাড়ি স্টার্ট দেবার আগেই ড্রাইভার জানিয়ে দিলো, স্যার তেল লাগবে।
আমি জানতে চাইলাম, তেল আগে থেকে নিয়ে আসেন নাই কেন? গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। পরে সাথের পুলিশ সদস্যরা জানালো যে অফিসার ডিউটি করেন- তেল তাকেই কিনে দিতে হয়। নিজের পকেটের টাকায় চলবে। শুধু তাই নয়- ড্রাইভার আর হেলপারকেও এক বেলা খাবারের ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট অফিসারকেই করতে হয়। লেগুনা সমিতি শুধু গাড়ির ব্যবস্থা করে দেয় সকাল-বিকাল। তেল আর শ্রমিকের খাবার তারা দেন না!
এখানেই শেষ নয়। থানায় প্রয়োজনীয় কাগজ, কলম, স্টেশনারি, বর্তমানে কম্পিউটার, প্রিন্টার, টোনার, এমনই অসংখ্য মালপত্র- কোন কিছুই সরকারি টাকায় কেনা নয়। হয় থানার ওসি ব্যবস্থা করেন, না হলে সংশ্লিষ্ট অফিসার নিজের টাকায় কেনেন। ভাবতে পারেন?
এলাকার বাসিন্দারা যেন নিশ্চিন্তে রাতের ঘুম কাটাতে পারেন- সেই ব্যবস্থা করতে রাত জেগে, নিজের গাঁটের টাকায় কেনা গাড়ির তেল খরচ করে পুলিশ ডিউটি করে। অন্যের নিরাপদ ঘুম নিশ্চিত করে! আমি যখন থানায় দায়িত্বে ছিলাম, তখন থানায় একটা সরকারি গাড়ি বরাদ্দ ছিল। সেই গাড়ির জন্য প্রতিদিন ১০ লিটার তেল সরকারি বরাদ্দ ঠিকই ছিল। কিন্তু সকাল-বিকাল চারখানা মোবাইল ডিউটিসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা বেসরকারি গাড়ির জন্য এক ফোটা তেল বরাদ্দ ছিল না। অবশ্য সরকারি গাড়ি ছাড়া অন্য গাড়ির জন্য তেল বরাদ্দের সুযোগই নাই।
অন্য কথায় আসি। আপনি যদি পৈশাচিক কায়দায় দিনে-দুপুরে বিএনপির সমাবেশে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় নেতাকর্মীদের হামলায় নিহত পুলিশ সদস্য আমিরুল ইসলামের মৃত্যুর বিষয়ে আলোকপাত করেন। তাহলে আমি বলব, আমাদের কষ্ট কিন্তু অন্য জায়গায়। আচ্ছা, একজন কনষ্টেবলের বেতন কত, কেউ জানেন? কেউ কি জানেন রাতদিন কঠোর পরিশ্রম করা পুলিশ সদস্যদের খাবার মেন্যুতে কি কি থাকে?
শুনলে অবাক হবেন দেশের যত পুলিশ লাইন, থানা, ফাঁড়ি আছে, কোথাও একজন পুলিশ সদস্য তার তিনবেলার খাবারের পেছনে দৈনিক ১০০ টাকার বেশি খরচ করতে পারেন না। শতকরা ৯৫ জন পুলিশই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন। ফলে, থানার বা পুলিশ লাইনের মেসের খাবারই ভরসা তাদের। বাড়িতে পরিবারের খরচ বাদ দিয়ে নিজের জন্য এর বেশি খরচ তারা করে উঠতে পারেন না। আমি যখন থানার দায়িত্বে ছিলাম, তখন থানার মেসের দৈনিক বিল আসত ৭৩ টাকার মত। একবার ভাবুন। একশত টাকায় তিনবেলা খাবার খেয়ে পুলিশ সদস্যরা কতটুকু শারীরিক ভাবে সামর্থ্যবান হবেন?
রাজনৈতিক হানাহানির ডিউটি, গুলিতে পুলিশ সদস্যদের গায়ে চড়াতে হয় ৫ কেজির বুলেট প্রুফ জ্যাকেট, দুই কেজির হেলমেট, লেগ গার্ড, সাথে থাকে কয়েক কেজির লম্বা অস্ত্র-সস্ত্র। এত কিছু গায়ে চড়িয়ে টানা ১২ ঘন্টা হরতাল ডিউটি, মিছিল-মিটিং ডিউটি, রোদ, ঝড় বৃষ্টিতে।
যে পুলিশ সদস্যকে শকুনেরা পিটিয়ে, ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে, কুপিয়ে মেরেছে- তিনি আসলে দলছুট ছিলেন। এই পুলিশ সদস্য কী দিনে দিনে নিম্নমানের খাবার খেয়ে অপুষ্টিতে ভুগছিলেন। নাকি প্রায় দশ কেজির অতিরিক্ত মালামাল শরীরে বইতে বইতে ক্লান্ত, অবসন্ন ছিলেন! নাকি দীর্ঘ দিন রোদ, ঝড়, বৃষ্টিতে ডিউটি করতে করতে অসুস্থতায় ভুগছিলেন? না হলে, অন্যরা কোনমতে প্রাণ নিয়ে পালাতে পারলেও তিনি কেন পারলেন না?
বর্বরেরা সেদিন অসংখ্য পুলিশ সদস্যকে একই কায়দায় পিটিয়েছে, কুঁপিয়েছে, অস্ত্র কেড়ে নিয়ে গেছে, পকেটের মানি ব্যাগ, মোবাইল নিয়ে গেছে। কারো মাথা থেঁতলে দিয়েছে, কাউকে রড-লাঠি দিয়ে মেরে মেরে হাত পা গুড়িয়ে দিয়েছে, এমনকি তারা যেন চিকিৎসা নিতে না পারে, সেজন্য সারাদেশের মধ্যে একমাত্র পুলিশের হাসপাতাল আগুন দিয়ে পুঁড়িয়ে দিয়েছে।
আরো তথ্য মিলে, বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য কোমায় আছেন। বেশ কয়েকজন চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। অঙ্গ হারিয়েছেন। ২০১৩ ও ২০১৪ সনেও একই কায়দায় শখানেক পুলিশ সদস্যকে কুপিয়ে, পুঁড়িয়ে মারা হয়েছিল, করোনাতেও ১১৭ জন মরলো!
এ কেমন চাকরি? অন্য সরকারি চাকুরেরা শুধু শুক্র-শনিবার হিসেব করলে বছরে ৫২ সপ্তাহে সাড়ে তিন মাস এমনি ছুটি পায়। আরও আছে ঈদ, পূজা, পার্বণ, রমজান, হরতাল, এমনি ১২ মাসে প্রায় ৫ মাস ছুটি। সে জায়গায় পুলিশ পায় বছর জুড়ে মাত্র ২০ দিনের ছুটি। সেটা পেতেও কত কাঠ-খড় পোড়াতে হয়। ছুটি না পেয়ে অনেকে পুলিশ আত্মহননের পথ পর্যন্ত বেঁছে নিতে দ্বিধা করেন নাই। অন্য চাকুরেরা সবাই দিনে ৮ ঘন্টার কাজ করেন। পুলিশের ঘন্টার শুধু শুরু আছে, শেষ নাই।
আপনি সকাল ৯টায় গেলেও ওসিকে থানায় উপস্থিত চাইবেন। রাত ৩/৪ টায়ও চাইবেন যেন আপনার ফোন ধরে। ব্যস্ততার কারণে পুলিশের বন্ধু-বান্ধব হারিয়ে যায়। আত্মীয়-স্বজন হারিয়ে যায়। পরিবারের সদস্যরা তাদের পুলিশ বাবা-ভাই-সন্তানদের দেখা পান, মাসে দু একদিনের জন্য। বলা যায় হঠাৎ করে।
আমি বলতে চাই না, সকল পুলিশই ফেরেশতা, ভালো মানুষ। কিন্তু দেশের নামকরা প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা করে এসে তাদের অনেকেই কেন এমন করে আচরণে, মননে- এতটা পরিবর্তিত হয়ে যায়? আপনাদের কি মনে হয় না। রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে, দিনের পর দিন শুধু পরিশ্রম আর পরিশ্রম করতে গিয়ে। নানা অসহনীয় মানসিক চাপ বইতে গিয়ে। পরিবার পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে থেকে, নিম্ন মানের অপুষ্টিকর খাবার খেয়ে খেয়ে, দেশের অধিকাংশ পুলিশ সদস্যই শুধু শারীরিক ভাবেই নয়, মানসিক ভাবেও অসুস্থ!
পুলিশের অবৈধ সম্পদের কথা যদি ভাবেন। আগে আপনার এলাকায় চারপাশে খোঁজ নিন গোপনে। কয়টি অট্টলিকা পুলিশ সদস্যের কার কার নামে আছে? অন্য পেশার লোকজনের কয়টা আছে? অনুপাতটা কি এক লক্ষ অনুপাত এক হবে? না ঢের বেশি? মিলিয়ে নিন। আমি হয়তো গণিতে অপারদর্শী নই।
আড়াই লক্ষের বিশাল বাহিনীর মধ্যে কিছু দুষ্ট মানুষ আছে তা ঠিক। কিন্তু সভ্য বলে যারা নিজেদের আত্ম অহমিকা নিয়ে গর্বিত ভাবেন- তাদেরকে প্রকাশ্যে রাজধানীর সড়কে আদিম চর্চায় মানুষ খুনের বিষয় নিয়ে এক চুল ভাবান্তরিত হতে দেখলাম না। তাদের মুখে নেই কোন কথা? সেদিনের ভিডিও ফুটেজ দেখে বলতে পারেন, বর্বরতার সংজ্ঞা কী? আর কিছু কি যোগ করতে হয়? পুলিশের মাথায় আঘাত। লাঠি ও রড দিয়ে থেঁতলে ফেলা! কি আজব দেশ।
অথচ, এই বাহিনীর সদস্যরাই দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ যোদ্ধা, প্রথম শহিদ, বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যে রাতে কাপুরুষের দল হামলা করেছিল, সে রাতেও প্রথম শহিদ একজন পুলিশ সদস্য।
এত বঞ্চনা, এত শ্রম, এত সব ত্যাগ- কিন্তু পুলিশের কোন বীর শ্রেষ্ঠ নেই, বীর উত্তম নেই, স্বীকৃতি নেই। কেউ প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশকে ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে দিয়ে বা আগুন দিয়ে পুঁড়িয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করলেও বিচার নেই। বিপদে পড়লে এদের দিয়েই কর্ম হাসিল, পরে ছুঁড়ে ফেলা…!
লেখক: সিনিয়র পুলিশ পরিদর্শক, চট্টগ্রাম সিআইডি।
বিবার্তা
বিষয়: # #পুলিশনামা