শুক্রবার ● ২৪ নভেম্বর ২০২৩
প্রথম পাতা » মতামত » দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং বিএনপি’র ভবিষ্যৎ
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং বিএনপি’র ভবিষ্যৎ
দেওয়ান ফয়সল: বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। একমাত্র বিএনপি ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিএনপি গত প্রায় ১৪ বছর রাজনীতি থেকে নির্বাসনে থাকার পরও যদি এবারের নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না করে, তাহলে তাদের রাজনীতির ভবিষ্যৎ কেমন হতে পারে তা নিয়েই আজকের লেখায় আলোকপাত করার চেষ্টা করবো।
সম্প্রতি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। বিএনপি সহ তাদের সমমনা কয়েকটি দল নির্বাচনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেও শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবিধান মোতাবেক নির্বাচন করার সিদ্ধান্তের ফলেই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হলো।
নির্বাচনের তফসিল অনুসারে মনোনয়ন পত্র দাখিলের শেষ তারিখ ৩০ নভেম্বর ২০২৩, যাচাই-বাছাই ১-৪ ডিসেম্বর, আপিল গ্রহণ ৬-১৫ ডিসেম্বর, প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১৭ ডিসেম্বর, প্রতীক বরাদ্দ ১৮ ডিসেম্বর, প্রচারণার শেষ তারিখ ৫ জানুয়ারী ২০২৪ এবং ভোট গ্রহণ ৭ জানুয়ারী ২০২৪।
এই তফসিল ঘোষণার পরপরই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আনন্দের জোয়ার বইতে শুরু করেছে সারা বাংলাদেশে। গ্রামগঞ্জ থেকে শুরু করে রাজধানী ঢাকা সহ বাংলাদেশের সবগুলো শহরে শুরু হয়েছে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করার জন্য নির্বাচনী ফরম কেনার হিড়িক। মানুষের মধ্যে জেগে উঠেছে প্রাণ চাঞ্চল্য। এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের মানুষ চায়, একটি সুন্দর এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন, যার মাধ্যমে তারা তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে ভোটের মাধ্যমে জয়যুক্ত করে তাদের এলাকার উন্নয়ন সাধন করতে।
গত ১৪ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের কাজ দেখে দেশের মানুষের প্রধানমন্ত্রীর উপর যেমন আস্থা গড়ে ওঠেছে ঠিক তেমনি বিশ্ববাসীর কাছেও। জনগণ অত্যন্ত আনন্দিত, আর এজন্যই আবারও ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে জয়যুক্ত করে ক্ষমতায় রাখতে বদ্ধ পরিকর তারা। রাজনীতিতে জনগণের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত, এখানে টাকা পয়সা, ছলচাতুরী, হিংসা কোন কিছুই কাজ করেনা।
১৮ নভেম্বর সকাল ১০টার পর বঙ্গবন্ধু এভিনিউ’র আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা নিজ এলাকা গোপালগঞ্জ-৩ আসনের জন্য সশরীরে মনোনয়ন ফরম কেনার মাধ্যমে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। বেলা ১১টার পর থেকেই দলীয় প্রার্থীদের জন্য ফরম কেনা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এ সময় মনোনয়ন প্রত্যাশীদের ভিড় জমে ওঠে। এর পরপরই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সহ কেন্দ্রীয় নেতারা মনোনয়ন ফরম কেনেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আসেন নৌকার প্রার্থীরা। (সূত্র: ইউকে বিডিটিভি.কম)
আওয়ামী লীগ ছাড়াও জাতীয় পার্টিও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মহাজোট থেকে ভোট করতে চান রওশন এরশাদ এবং দলীয় মনোনয়ন দেবেন জিএম কাদের। তাদের মধ্যে সিদ্ধান্ত হয়েছে নির্বাচনে আগ্রহী প্রার্থীরা দলীয় প্রতীক ’লাঙ্গল’ ছাড়াও চাইলে মহাজোটের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে পারবেন। গত ১৮ই নভেম্বর শনিবার নির্বাচন কমিশনে এক চিঠিতে এ তথ্য জানিয়েছেন জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ।
উল্লেখ্য যে, গত ১১ নভেম্বর আওয়ামী লীগ, বিএনপি সহ ৪৪টি নিবন্ধিত দলকে প্রার্থী মনোনয়নকারীর নাম জানাতে বলেছিল ইসি। ইসি’র চিঠির এ ধারাবাহিকতায় চলছে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশ গ্রহণের প্রস্তুতি।
বিএনপি নেতাদের নির্বাচনে অংশ গ্রহণের হিড়িক
শুধু জাপাই নয়, বিএনপি’র একটি অংশ ’তৃণমূল বিএনপি’ নাম দিয়ে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করছে। গত ১৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনষ্টিটিউশন মিলানায়তনে তৃণমূল বিএনপি’র কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। সে কাউন্সিলে তৃণমূল বিএনপি’র চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব পান শমসের মুবিন চৌধুরী। কাউন্সিলের পর গত ১২ অক্টোবর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশনের সঙ্গে ’তৃণমূল বিএনপি’ ৩০০ আসনে প্রার্থী দেয়ার কথা জানান শমসের মবিন চৌধুরী।
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট ৬ আসন থেকে প্রতিদ্বন্ধিতার লক্ষ্যে দলের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন শমসের মবিন চৌধুরী। গত রবিবার রাজধানীর তোপখানা রোডের মেহেরবা প্লাজাস্থ দলের কেন্দ্রীয় কার্য্যালয় থেকে ফরম সংগ্রহ করেন তিনি। বিভিন্ন দলকে নিয়ে জোটবদ্ধভাবে ৩০০ আসনে নির্বাচন করবে বলে জানিয়েছেন শমসের মবিনের দলের মহাসচিব তৈমুর খন্দকার। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি আরও বলেন, অনেক দল আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। শক্তিশালী জোট গঠন করে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করবো। আর যদি নাও পারি আমরা হবো প্রধান বিরোধী দল।
’প্রথম আলো ডটকম’ এর ২০ নভেম্বর প্রকাশিত অন্য এক খবরে জানা গেছে, নতুন নিবন্ধিত দল ’’বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে (বিএনএম) যোগ দিয়েছেন বিএনপি’র সাবেক চার সাংসদ। তারা হলেন শাহ আবু জাফর (ফরিদপুর ১ আসনের সংসদ সদস্য) তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, ঝিনাইদহ ১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মো: আব্দুল ওয়াহাব, সুনামগঞ্জ ৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য দেওয়ান শামসুল আবেদিন এবং বরগুনা ২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক আব্দুর রহমান।
এদিকে ইসি’র পক্ষ থেকে বিএনপি নেতৃবৃন্দদের জানানো হয়েছে যে, তারা যদি নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন তাহলে প্রয়োজনে তাদের সুবিধার জন্য নির্বাচনের তারিখ পেছানো হবে। এরপরও যদি বিএনপি নেতৃবৃন্দ এ আহ্বানে সাড়া না দেন, তাহলে বলতে হবে ’ভাঙ্গা কপাল জুড়া লাগে না’র মতো অবস্থা হবে তাদের।
এখন প্রশ্ন হলো, আগামী জানুয়ারীর ৭ তারিখে দ্বাদশ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এতো উৎসাহ কেন? তার উত্তর হচ্ছে একটাই, দেশের উন্নয়ন। প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার অক্লান্ত পরিশ্রমে গত ১৪ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশের যে উন্নয়ন সাধিত হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত উন্নয়নের এ ধারা অব্যাহত রয়েছে তার করণেই দেশের আপামর জনগণের মধ্যে আস্থা স্থাপনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের সুনাম ধরে রেখেছেন। তার জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে।
আওয়ামী লীগ তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী চিন্তাধারা এবং দেশের মানুষের সুযোগ সুবিধার কথা চিন্তা করে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে এক অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মান করা থেকে শুরু করে ঢাকায় ’মেট্রোরেল’ চালু, নতুন এবং আকর্ষণীয় করে নির্মিত ’হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের’ টার্মিনাল উদ্বোধন, চট্টগ্রামে ’বঙ্গবন্ধু টানেল’ নির্মাণ এবং উদ্বোধন, চট্টগ্রামে আইকনিক রেল ষ্টেশন নির্মান এবং সম্প্রতি উদ্বোধন সহ অসংখ্য সেতু, কালভার্ট, রাস্তা নির্মান করে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়ানো, ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটানোর মাধ্যমে জনগণকে সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। মসজিদ, মাদ্রাসা নির্মাণ, দরিদ্র অসহায় মানুষের জন্য ঘরবাড়ি তৈরী করে দেয়া, টিসিবি’র মাধ্যমে কম দামে মানুষের নিত্য প্রয়োজনী খাবার, কাপড় চোপড় ইত্যাদি কম মূল্যে বিক্রি করা ইত্যাদি কারণে শেখ হাসিনা হয়ে ওঠেছেন জনগণের প্রাণপ্রিয় নেত্রী। বাংলাদেশের জনগণ আগামী নির্বাচনে আবারও আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে শেখ হাসিনাকে নির্বাচিত করে তাঁর হাতকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে দেশের অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে চায়, আর এ কারণেই নির্বাচনী আমেজ আজ বাংলাদেশের ঘরে ঘরে।
অন্যদিকে বিএনপি’কে বারবার অনুরোধ করা সত্বেও কারা তাদের এক দফা আন্দোলন থেকে সরে আসতে নারাজ। বিএনপি’র শাসনামলের কথা মনে হলেই দেশের সাধারণ জনগণ এখনও কেঁপে ওঠে। নির্বাচন বানচালের লক্ষ্যে বর্তমানে বিএনপি দেশে যে অরাজকতা সৃষ্টি করেছে, দেশের মানুষের কাছে তারা এক ঘৃন্য রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিগনিত হচ্ছে। যানবাহনে আগুন দেয়া, রেলের বগিতে অগ্নিসংযোগ, ককটেল বিষ্ফোরণের মাধ্যমে জনগণের জানমালের ক্ষতি সাধন, রাস্তার মধ্যে গাড়ির টায়ার জ্বালিয়ে মানুষের যাতায়াতে বাধা প্রদান করা এবং রাস্তা নষ্ট করা, হরতাল দিয়ে দোকান পাট বন্ধ করে দেয়া ইত্যাদি সবকিছুই জনগণের স্বার্থ-বিরোধী কাজ, যার ফলে দেশের জনগণ মনে করে বিএনপি জনগণের কল্যাণের জন্য কিছুই করতে পারবে না, শুধু মাত্র অশান্তি সৃষ্টি করা ছাড়া।
যদিও কিছু সংখ্যক মানুষ চেয়েছিল বিএনপি ক্ষমতায় আসলে হয়তো ভাল হবে, কিন্তু বর্তমানে তাদের জ্বালাও পোড়াও দেখে মানুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চয় হয়েছে। এখন দেশের মানুষ দিন গুনছে কবে নির্বাচন হবে আর বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটির হাত থেকে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে তাদের রক্ষা করবে। বিএনপি’র মনে রাখা উচিৎ, বর্তামানে তাদের জ্বালাও পুড়াও এর রাজনীতি জনগণকে তাদের রাজত্বের অতীতের কথা-ই মনে করিয়ে দেয়। বিএনপির প্রবীণ নেতৃবৃন্দের নিশ্চয়ই হয়তো মনে আছে, ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় আজ যারা তাদেরকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে, তারাই সে সময় আমাদের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল এবং পাকিস্তানী শাসকদের পক্ষ নিয়ে ভারত মহাসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে আমাদের হুমকি দিয়েছিলো। তার পরিণাম কি হয়েছিল এই প্রবীণ বিএনপি নেতৃবৃন্দ জানেন।
বাংলাদেশ ঠিকই একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নিয়ে আজ বিশ্বের বুকে একটি স্বনির্ভর রাষ্ট্রে পরিণত হতে চলেছে। বিশ্ববাসির নজর আজ বাংলাদেশের দিকে। যে বিশ্ব শক্তি পাকিস্তানকে সহযোগিতা করে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলো, সেই শক্তির সাথে হাত মিলিয়ে ক্ষমতায় বসার চিন্তাধারা কি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া নয়?
বিএনপি নেতৃবৃন্দের মনে রাখা উচিৎ, তাদের বিদেশী প্রভুরা কোন দিনই তাদেরকে ক্ষমতায় বসাতে পারবে না। ক্ষমতায় যেতে হলে জনগণের ম্যান্ডেট দরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিস্কারই বলে দিয়েছেন, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, এখানে অন্য দেশের হস্তক্ষেপ চলবে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী, বীর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অস্ত্র জমা দিলেও ট্রেনিং জমা দেয়নি।
বিএনপি নেতৃবৃন্দকে আরও মনে রাখতে হবে, এবারের নির্বাচনে যদি তারা অংশ গ্রহণ না করেন, জনগণের সংস্পর্শে না যান, তাহলে ভবিষ্যতে বিএনপি রাজনৈতিক ভাবে বিলিন হয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
লেখকঃ দেওয়ান ফয়সল, কলামিষ্ট, সিনিয়র সাংবাদিক ও সদস্য লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব
বিষয়: #নির্বাচন ২০২৪