মঙ্গলবার ● ২৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
প্রথম পাতা » অনুপ্রেরণা (গল্প) » #সম্মান
#সম্মান
-শুনলাম তুমি নাকি ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছো।
-জ্বী আংকেল সিএসই তে।
-বাহ! খুবই ভালো। আমিতো ভেবেছিলাম মাদ্রাসার ছাত্রদের দৌড় ঐ মসজিদ পর্যন্তই। তা যাই হোক আমার ছেলেটাকে পড়াতে পারবে?
-দুঃখিত আংকেল সম্ভব না অনেকগুলো টিউশন ঝুলে আছে কিন্তু সময়ের অভাবে সেগুলো করতে পারছি না।
-আরে তোমাকে টাকা বাড়িয়ে দিবো চিন্তা করোনা। এখন যে পড়ায় তাঁকে চার হাজার দেই তোমাকে ছয় হাজার দিবো।
-দুঃখিত আংকেল! আমি এখন এক সাবজেক্টের জন্যই ছয় হাজার নেই আর সেখানে আপনার ছেলের প্রতি দুইঘন্টা সময় নষ্ট করে এতো কম টাকায় পড়াতে পারবোনা। এখন যে পড়ায় তাঁকেই রেখে দিন সমস্যা কোথায়?
আমার কথা শুনে অনেকটা অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলেন তিনি। হয়তো ভাবতে পারেননি এরকম কিছু বলবো। তার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে বললাম,
-আজ আসি আংকেল! হাতে একদম সময় নেই। আরেকটি টিউশনে যেতে হবে।
এই বলেই স্থান ত্যাগ করলাম অনেকটা সাবলীল ভঙ্গিমায়। আমি জানি তিনি এখনো আমার চলার পথে একনয়নে তাকিয়ে রয়েছেন।
ঘটনাটা চারমাস আগেকার…
অফিস থেকে বাবাকে চাকরিচ্যুত করার দরুন খুব অভাব অনটনে দিন কাঁটছিলো আমাদের। আমি তখন একটি টিউশনের জন্য খুব দৌড়াদৌড়ি করছিলাম। হঠাৎ একদিন প্রতিবেশীর সুবাধে এই আংকেলের বাড়িতে উপস্থিত হই। তিনি নাকি তাঁর ছেলের জন্য একটি ভালো মানের টিউশন টিচার খুঁজছেন। কিন্তু আংকেলের বাড়িতে যেয়ে যে এতোগুলো প্রশ্নের সম্মুখীন হবো তা যেন আমার ভাবনাতেই ছিলনা। যখন তিনি আমার মুখ থেকে শুনতে পেলেন যে আমি মাদ্রাসা থেকে ইন্টার পাশ করেছি তখন থেকেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম তিনি আমাকে রাখতে চাননা। প্রশ্নগুলো ছিলো এমন,
-ইংলিশ ভালো করে পারোতো? গণিতে দক্ষতা কীরূপ? আচ্ছা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে ইংলিশে কিছু বলো।
আমার নিকট মনে হচ্ছিল আমি টিউশন করতে আসিনি বরং ইন্টারভিউ দিতে এসেছি যদিও সবগুলো প্রশ্নের উত্তর খুব দক্ষতার সহিতই দিয়েছিলাম। সর্বশেষ আমার বিগত ভালো রেজাল্টের কথা শুনেও যেন তাঁর মন ভরলো না। কারণ মাদ্রাসার ছাত্র হিসেবে আমার প্রতি তাঁর যে তুচ্ছ মনোভাবটা মনের ভিতরে গেঁথে ছিল সেটা বোধহয় একটুও কাঁটেনি। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন মাদ্রাসার ছাত্রদের দৌড়তো মসজিদ পর্যন্তই সে আর আমার ছেলেকে কী অংক আর ইংরেজি শিখাবে? সমাপ্তিতে তিনি অনেকটা ভদ্রতার খাতিরে বললেন,
-সকালে আমি আরো একটি টিচারের সাথে কথা বলেছি সে চার হাজার টাকার বিনিময়ে সব সাবজেক্ট পড়াবে। তোমার চাওয়া পাওয়া কীরকম?
আমি অনেকটা অসহায় হয়েই বলেছিলাম,
-আংকেল আমাকে তিন হাজার দিলেই হবে।
অনেকটা আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সেদিন তাঁর গৃহ ত্যাগ করলেও এক সপ্তাহেও তাঁর দ্বিতীয় ডাক শুনতে পাইনি। পরবর্তীতে জানতে পারি তিনি সেই কলেজ পড়ুয়া শিক্ষককেই চার হাজার টাকার বিনিময়ে নিজ ছেলের জন্য রেখে দিয়েছেন। এই সংবাদটি শোনার পর মাদ্রাসার ছাত্র হিসেবে নিজেকে এতোটাই তুচ্ছ মনে হচ্ছিল যে যা প্রকাশ করার সক্ষমতা আমার আজও তৈরি হয়নি।
আজ নাফিসকে যখন পড়ানো শেষ করে বাহিরে বের হবো ঠিক তখনি নাফিসের আম্মু আমায় ডাক দিলেন।
-জ্বী আন্টি বলেন।
-তোমার বেতনটা নাও। তুমি কী আগামী মাস থেকে নাফিসকে পড়াবে?
-জ্বী আন্টি অবশ্যই পড়াবো।
এই বলেই মুচকি হেসে টাকাটা হাতে নিয়ে স্থান ত্যাগ করলাম। সচরাচর স্টুডেন্টের অভিভাবকের সামনে আমার টাকা গণনা করার অভ্যাস নেই তাই দরজা থেকে বের হয়েই টাকায় হাত বুলিয়ে এক এক করে গণনা শুরু করলাম। অবাক করা বিষয় হলো আজ ছয়টা পাঁচশ টাকার নোট কিন্তু এখানেতো চারটা পাঁচশ টাকার নোট থাকার কথা। আমি অনেকটা হন্তদন্ত হয়ে উল্টোদিকে ঘুরে সাথে সাথেই দরজায় নক করলাম। নাফিসের আম্মু দরজা খুলে অনেকটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি তাঁর ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে বললাম,
-আন্টি! আপনি ভুলবসত হয়তো আমাকে এক হাজার টাকা বেশি দিয়ে ফেলেছেন।
-আরে নাহ! আমি ইচ্ছে করেই তোমাকে এক হাজার টাকা বেশি দিয়েছি। তুমি যে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হয়েও আমার ছেলেকে এতো কম টাকায় পড়াচ্ছো সেটা ভেবেই অবাক হই। চিন্তা করলাম তোমার যোগ্যতার ফলস্বরূপ আমিও আমার সামর্থ্য অনুযায়ী একটু বাড়িয়ে দেই। জানোইতো নাফিসের আব্বু ছোটখাটো একটি চাকরি করে। মাস শেষে যে বেতন পায় তা ঘর ভাড়াতেই চলে যায় অধিকাংশ।
এই বলেই স্থির হলেন তিনি। আমি ক্ষানিকটা মুচকি হেসে বললাম,
-আন্টি! আমি যখন নাফিসকে পড়ানো শুরু করি তখন কিন্তু আমি ঢাকা ভার্সিটির স্টুডেন্ট ছিলাম না কিন্তু প্রভুর কল্যাণে আজ আমি প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের একজন সদস্য। তখন আমার টিউশনটা খুব দরকার ছিলো আর আপনারা আমাকে মাদ্রাসার ছাত্র হিসেবে তুচ্ছ না করে বরং আমার জ্ঞানটা কে প্রাধান্য দিয়ে নাফিসের টিউশন টিচার হবার সুযোগ দিয়েছিলেন। জানেন আন্টি! আপনি যেদিন আমাকে প্রথম বেতন হাতে তুলে দিয়েছিলেন সেদিন অকল্পনীয়ভাবে সেই টাকা মুষ্ঠিবদ্ধ করে আমি আড়ালে বসে খুব কেঁদেছিলাম। এমনকি সেই টাকা দিয়েই আমি মায়ের জন্য ঔষধ কিনেছিলাম। আমার পারিশ্রমিকটা হয়তো কম ছিলো কিন্তু তাঁর গুরুত্বটা ছিলো আকাশচুম্বী। আমি হয়তো আজ টিউশন টিচারের দিক দিয়ে অনেক মর্যাদাসম্পন্ন কিংবা আমার মূল্যটা হয়তো অনেক বেশি কিন্তু নাফিসের শিক্ষক হিসেবে আমি শুরুতে যেমন ছিলাম এখনো তেমনি আছি আর ভবিষ্যতেও তেমনি থাকবো। আর চিন্তা করবেন না, নাফিসকে পড়ানো আমি কখনোই বাদ দিবোনা। আর যদি বাদ দেই তবে সেটা হবে সম্মানের প্রতীক কে নিজ হাতে চূর্ণ করা। এই নিন আন্টি এক হাজার টাকা।
আন্টি আমার মনের অজানা কথাগুলো শুনে অনেকটা কাঁপা কাঁপা হাতে টাকাটা নিয়ে চোখকে আর স্থির রাখতে পারলেন না বরং দুফোঁটা অশ্রু নিজের অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফেলে দিলেন। এই অশ্রুতে কোনো বেদনা লুকিয়ে নেই বরং আছে অজস্র সম্মানের ছোঁয়া।
এটা কোনো কল্প কাহিনী নয় বরং ঢাকা ভার্সিটির ক ইউনিটের ২০১৮ ১৯ শিক্ষবর্ষের জাতীয় মেধাতালিকায় ৬৩ নম্বরে থাকা এক মাদ্রাসায় পড়ুয়া ভাইয়ের ঘটনা। অনেকেই হয়তো জানেন না যে মাদ্রাসার ছাত্ররাও দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক বিভাগে প্রতিবছর প্রথম দশ জনের ভিতরে থাকে মাদ্রাসার ছাত্ররা। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের প্রতি আপনাদের ভুল ধারণা ভাঙ্গানোটাই ছিল মূলত আমার এই লেখনীর প্রয়াস।
ধন্যবাদ সবাইকে।।।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত
বিষয়: ##সম্মান