সোমবার ● ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » পরিবেশ ও স্থানীয় প্রশাসন নীরব
পরিবেশ ও স্থানীয় প্রশাসন নীরব
এপারে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলা ওপারে পটিয়া উপজেলার কোলাগাঁও। মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা শিকলবাহা খালে পোশাক কারখানার কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি পড়ে দূষিত হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। যদিও পোশাক কারখানা কর্তৃপক্ষ অভিযোগ অস্বীকার করে পরিবেশ পাঠাতে বলেন।
জানা যায়, এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) ব্যবহার করে বর্জ্য জল শোধন করার সরকারি নির্দেশনা থাকলেও পোশাক শিল্প গার্মেন্টস এবং রাসায়নিকের মতো শিল্পগুলিতেও কেউ কেউ ইটিপি ব্যবহার করছে না। এমন অভিযোগ অহরহ।
শিকলবাহা ও কোলাগাঁও এলাকার মানুষের অভিযোগ, শিকলবাহা খাল সংলগ্ন কালারপোল চাপড়া এলাকার ‘ফোর এইচ ডায়িং এন্ড প্রিন্টিং লিমিটেড’ নামক পোশাক কারখানার লাল কালো মিশ্রিত পানিতে শিকলবাহা খালটি মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে।
জেলেরা বিবার্তাকে বলছেন, খালে দেখা মিলছে না আগের মতো দেশীয় জাতের মাছও।
অন্যদিকে, ওই খালের ওপর নির্ভর কৃষির চরম সর্বনাশ হচ্ছে আর অন্যদিকে পানি ও পরিবেশ দূষণের কারণে রোগ বালাই ছড়িয়ে পড়ে অসুস্থ হচ্ছে পার্শ্ববর্তী লোকজনও।
যদিও ফোর এইচসহ একাধিক কারখানা খাল দূষণে দায়ী হলেও পরিবেশ অধিদপ্তর কিংবা স্থানীয় প্রশাসন দূষণ রোধে স্থায়ী কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। উল্টো স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও নেতাদের ‘ম্যানেজ’ করে চালাচ্ছে দূষণ। অথচ প্রতিনিয়ত একাধিক কারখানার দূষিত বর্জ্য শিকলবাহা খাল হয়ে পড়ছে কর্ণফুলী নদীতে।
১১ ফেব্রুয়ারি, রবিবার সরেজমিনে গিয়ে, পটিয়া ও কর্ণফুলী উপজেলার সংযোগে কালারপোল বেইলি সেতুতে দাঁড়ালে খালটির দূষণ দৃশ্য পাত হয়। সেতু থেকে নেমে নৌকা নিয়ে ঘুরে দেখা যায়, খালের পানির রং কুচকুচে কালো। প্রচণ্ড দুর্গন্ধযুক্ত ওই পানি। দুর্গন্ধের কারণে নাক বন্ধ রাখতে হয়। কারখানার পানি গড় গড় সরাসরি পড়ছে খালে। খালের পানি সাদা মাটি রঙের হলেও, কারখানা থেকে বেরিয়ে আসা পানি কেমিক্যাল মিশ্রিত তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
দুই উপজেলার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত কয়েক বছরে শিকলবাহা খাল পাড়কে নির্ভর করে দুপাড়ে একাধিক কল কারখানা গড়ে উঠেছে। ওই সব কারখানার বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে খাল। এর মধ্যে ফোর এইচ কারখানার নাম বেশি বলছে এলাকার মানুষ। যদিও ইটিপি দ্বারা পরিশোধিত হয়ে বর্জ্য পানি খালে যাচ্ছে বলে কর্তৃপক্ষের দাবি।
কিন্তু অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের সাথে ফ্যাক্টরি কর্তৃপক্ষের সুসম্পর্ক থাকায় কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য শিকলবাহা খালে ফেলতে কারো কোন সমস্যা হচ্ছে না। সরাসরি মোটা পাইপের মাধ্যমে বর্জ্য নদীতে ফেললেও এখনো পরিবেশ অধিদপ্তর কিংবা বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির কর্মকর্তাদের নজরে আসেনি। এভাবে চলছে কালারপোলের অন্যান্য কারখানাগুলোও।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম গবেষণাগারের সিনিয়র কেমিস্ট মো. হোযায়ফাহ্ সরকার বিবার্তাকে বলেন, ‘যেকোনো কারখানার বর্জ্য নদী বা খালে ফেলা মানেই পানি দূষিত করা। কারণ কারখানার বর্জ্যে নানা রং, কেমিক্যাল ও বিষাক্ত পদার্থ থাকে। যা স্যাম্পল সংগ্রহ করে দেখতে হবে।’
চাপড়া গ্রামবাসীর অভিযোগ, কারখানার মালিকেরা গ্রামের প্রভাবশালীদের ‘ম্যানেজ’ করে এমন দূষণ ঘটাচ্ছেন। গ্রামের মানুষ অভিযোগ করলেও কানে তোলেন না। উল্টো চাকরিচ্যুত করার হুমকি দেন।
গত বুধবার দুপুরে এই পোশাক কারখানার দূষণের বিষয়ে কথা বলতে গেলে নিরাপত্তাকর্মীরা সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ায় ভেতরে প্রবেশ করতে দেননি। পরে জনসংযোগ কর্মকর্তার মোবাইল নম্বর চাইলেও অসহযোগিতা করেন।
কোলাগাঁও ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক বলেন, স্থানীয় ভাবে কোন ধরনের অভিযোগ পাইনি। পেলে কারখানার মালিকের সাথে কথা বলে জনস্বার্থে যা করার অবশ্যই করব।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলার পরিদর্শক মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন ফয়সল বিবার্তাকে বলেন, ‘আমি যোগদান করেছি মাত্র ১০ দিন হয়েছে। আমাকে এখনো জোন এরিয়া দেওয়া হয়নি। তারপরেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানাবো।’
পটিয়া উপজেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও ইউএনও মো. আলাউদ্দিন ভুঞা জনী বিবার্তাকে বলেন, ‘আমি সরেজমিনে গিয়ে দেখব এই খালে কোন কোন প্রতিষ্ঠান কারখানার বর্জ্য ফেলছে। তারপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। বিষয়টি পরিবেশ অধিদপ্তরকেও আপনারা জানাতে পারেন।’
এদিকে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে দূষণের বিষয়টি অস্বীকার করে ফোর এইচ গ্রুপের পরিচালক মো. হাসান জ্যাকি বিবার্তাকে বলেন, ‘খালে যে পানি গুলো পড়ছে তা দূষিত নয়। আপনার হয়ত এ সম্পর্কে ধারণা নেই। আপনি ডায়গনসিস করেছেন। প্রতিউত্তরে প্রতিবেদক পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষণাগার ডায়গনসিস করতে পারে এমনটি জানালে চেয়ারম্যান জানান, তাহলে পরিবেশ অধিদপ্তরকে পাঠান তারা দেখুক। আমার কারখানায় চট্টগ্রামের সবচেয়ে বেস্ট ইটিপি রয়েছে। যা আর কারো নেই। সব কিছুর মাত্রা ঠিক রেখে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যক্রম সম্পন্ন হচ্ছে।’
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলার উপ-পরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার বিবার্তাকে বলেন, ‘ইটিপি ব্যবহার না করে সরাসরি খালে বর্জ্য ফেলে পরিবেশের ক্ষতি করলে যেকোনো কারখানার বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর আইনি ব্যবস্থা নিবে। বাকিটা অভিযানে জানতে পারবেন।’
একটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামখ্যাত রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. মমিনুল ইসলাম তার গবেষণায় জানিয়েছেন, সাধারণত যেকোনো রং করার প্রক্রিয়ায় ১০-১৫ শতাংশ রং বর্জ্যপানিতে থেকে যায়। এ রং পানি ও মাটির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। পোশাক কারখানাগুলোতে কাপড় রং করার পর পানিতে যে রং থেকে যায়, সেগুলো পানির বিশুদ্ধতা নষ্ট করে।
তিনি আরও বলেন, প্রচলিত ইটিপিগুলোয় বিশেষ ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য বর্জ্যপানি থেকে রং শোষণের কাজে ব্যবহার করা হয়। কারখানায় ইটিপিগুলো পরিচালনায় প্রয়োজনীয় রাসায়নিক দ্রব্য আমদানিতে প্রচুর অর্থ বিদেশে চলে যায়। তা ছাড়া এই রং শোষণকারী পদার্থ কিছুটা হলেও পানিতে থেকে যায়।
প্রসঙ্গত, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের লেবার ইন্সপেকশন ম্যানেজমেন্ট অ্যাপ্লিকেশন (লিমা) এর তথ্য বলছে, পটিয়া কালারপোল আরাকান সড়কের পোশাক তৈরি প্রতিষ্ঠান (নিটিং) ফোর এইচ ডাইং এন্ড প্রিন্টিং লি. এর কারখানার কোড এবং কালার কোড সিএইচটি-০৭২।
গত ৪ বছরে একবার মাত্র মূল্যায়নের ধরণ জানতে কারখানা পরিদর্শন করা হয়। পরিদর্শনে অগ্নি, বৈদ্যুতিক ও কাঠামোগত মূল্যায়ন শতভাগ বলে উল্লেখ করা হয়। আর রেমিডিয়েশন সার সংক্ষেপ সার্বিক অগ্রগতি ৮৪ ভাগ জানানো হয়। তবে ২০১৫ সালের সর্বশেষ বার্ষিক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বর্জ্য ব্যবস্থায় আধুনিক কোন পদ্ধতির কথা চোখে পড়েনি।
বিষয়: #কারখানা #কেমিক্যাল #খাল #দূষিত #নীরব #পরিবেশ #পানি #প্রশাসন #শিকলবাহা #স্থানীয়