শিরোনাম:
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১

Somoy Channel
বুধবার ● ২৪ জানুয়ারী ২০২৪
প্রথম পাতা » সাহিত্য রম্যগল্প » গল্প: সরি
প্রথম পাতা » সাহিত্য রম্যগল্প » গল্প: সরি
৫৬ বার পঠিত
বুধবার ● ২৪ জানুয়ারী ২০২৪
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

গল্প: সরি

গল্প: সরিবাসের মধ্যে স্কুল ড্রেস পরিহিত মেয়েটির নিতম্বে চাপ দিয়ে একটি হাত দ্রুত সরে গেল। মেয়েটি দুইজন মানুষকে পাশ কাটিয়ে আওলাদ এর সামনে এসে উপস্থিত। ঘৃণাভরা স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি আমার গায়ে হাত দিলেন কেন?”
আওলাদ চূড়ান্ত অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,
“কী করেছি? আমি কোথায় আর তুমি কোথায়? আমি তোমার গায়ে হাত দেব কীভাবে?”
-কীভাবে হাত দিয়েছেন জানেন না? খুব বাজেভাবে স্পর্শ করেছেন আপনি।
-দেখো মেয়ে, বাসের মধ্যে নাটক করবে না। এমনি ভীড়ের মধ্যে দম ফেলার অবস্থা নেই। দেখেন না ভাই, আমি এখানে দাঁড়িয়ে। আর মেয়েটি দুইজন মানুষের সামনে। দুইজন মানুষ ডিঙিয়ে আমি কী করে এই মেয়ের গায়ে হাত দেব?
আওলাদের বক্তব্যে আরো দুইজন সমর্থন জানালো। একজন মেয়েটিকে বলল,
“এই মেয়ে, তোমার দুই পাশে যারা দাঁড়িয়েছে, তাদের ডিঙিয়ে এই মানুষটা কীভাবে তোমার গায়ে হাত দিলো?”
মেয়েটির মা এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটির হাত ধরে টানছে আর বলছে,
“চলে আয় শায়লা। চুপ কর, বাদ দে।”
শায়লা আবারও আওলাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“দেখেছেন? আমার মা চুপ করতে বলছে। কেন বলছে জানেন? আমি মেয়ে, আমার সম্মান বাঁচাতে। বাসে, মানুষের ভীড়ে অপরাধ করবেন আপনারা, অথচ আমাদের কেন সম্মান নষ্ট হবে বলতে পারেন? কেন চুপ থাকতে হবে আমাদের? ঠিক আছে আমি চলে যাচ্ছি, কিন্তু সরি বলুন।”
আওলাদকে এবার চূড়ান্ত রকমের রাগান্বিত মনে হচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে অদ্ভুত রকমের ঘর্ষণ দিয়ে রাগের কিছুটা জানান দিলো। তারপর বলল,
“সরি বলার অর্থ হলো আমি অপরাধী। অপরাধ না করে সরি কেন বলব?”
-আপনি ভালো করেই জানেন আপনি অপরাধ করেছেন, সরি বলেন।
শায়লার মা শায়লাকে হাত ধরে টেনে বাসের সামনের দিকে চলে যাচ্ছে। বাসের গতি কমেনি। হয়তো এখানকার পরিস্থিতী সম্পর্কে ড্রাইভারের কানে কোনো খবর যায়নি। শায়লা দুইজন মানুষের আড়ালে চলে গেলেও তার মুখ থেকে আবারও উচ্চারিত হলো,
“আঙ্কেল, সরি বলুন।”
আওলাদ সামনের দুইজনের দিকে মুখ করে উপহাসের স্বরে বলল,
“কোত্থেকে যে আসে এরা! যেখানে পুরুষ মানুষের ভীড় বেশি, সেখানেই ডলা খেতে চলে আসে।”
আওলাদ তার মুখের কথা শেষ করলেও মনে মনে কিছুটা অপমানিত হয়েছে। মেয়েটি তাকে আঙ্কেল ডেকেছে। তার বয়স এখন সাতাশ চলে। এই বয়সে নিজেকে আঙ্কেল ভাবতেই অপমানটা পাখির বিষ্টার মতো গায়ে লেগে যাচ্ছে। এখনো সে যুবক। হঠাৎ বাসটি ব্রেক কষল। শায়লা ও তার মা নেমে গেল। হয়তো তাদের গন্তব্য এখানেই। শায়লা বাসের জানালা বরাবর এসে চিৎকার করে বলছে,
“আঙ্কেল, সরি বলুন।”
আওলাদ না শোনার ভান করে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। ভাবছে তুলির কথা। সকালে আসার সময় বলে দিয়েছে,
“আব্বু আজ আমার নতুন জামা চাই।”
তাড়াতাড়ি বের হওয়ার সময় তুলির এই কথাটুকুই কানে এসেছিল। জমির খারিজ সংক্রান্ত কাগজ হস্তান্তর করতে এসে সারাদিন পেরিয়ে গেল। তুলির কথাটি একটিবারের জন্য মনে আসেনি। আওলাদ ভাবছে, কালই তুলিকে একটি নতুন জামা কিনে দিবে। কিন্তু এই ভাবনাটি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। মস্তিষ্কের এক পাশে যেন বারবার একটি কথা হাতুরিপেটা করছে,
“আঙ্কেল, সরি বলুন।”
বাস থেকে নেমে আওলাদ সোজা বাড়ির পথ ধরল। মাথাটা কেমন যেন করছে। সারাদিন গোসল হয়নি। এজন্যই হয়তো একটা ভোতা যন্ত্রনা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মোড় ঘুরে রাস্তার পাশের দেয়ালে চোখ গেল আওলাদের। দুই তিনটা দেয়াল জুড়ে একই কথা লিখে রেখেছে কেউ।
“সরি প্রিয়াংকা, ফিরে এসো।”
কোনো প্রেমিক হয়তো তার প্রেমিকার রাগ-অভিমান ভাঙাতে এই দেয়াল লিখন এর চিন্তা মাথা থেকে বের করেছে। কিন্তু বাক্যটিতে ‘সরি’ থাকার কারণে আওলাদের মাথার ভোতা যন্ত্রনা যেন আরো বেড়ে গেল। আর কেউ যেন কানের ভেতর ঢুকে সুর করে সেই কথাটি বলছে,
“আঙ্কেল, সরি বলুন।”
আউলাদ ঘরে ঢুকে দেখল রাজিয়া তার মেয়ে তুলিকে নিয়ে টিভি দেখছে। রাজিয়ার প্রতি আওলাদের কিছুটা রাগ হলো। মনে হচ্ছে পাঁচ বছরের মেয়েটাকেও রাজিয়া সিরিয়াল দেখানোর অভ্যেস গড়ে তুলবে। আওলাদ চোখ বড়ো করে রাজিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তোমাকে কতবার বলেছি, তুলিকে নিয়ে বসে এসব সিরিয়াল দেখবে না। কথা কানে যায় না তোমার?”
রাজিয়া বুঝতে পারল সারাদিন খাটুনি শেষে এসে এই দৃশ্য দেখে আওলাদের মেজাজ চরমে। এখন তর্ক করা ঠিক হবে না। তাই নরম সুরে বলল,
“সরি, সরি। তুলি কখন এসে আমার পাশে বসল, টের পাইনি। ”
আওলাদের মাথা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে ভোতা যন্ত্রনায়। আজ যেখানেই যাচ্ছে, সবখানে যেন সরি’র উপস্থিতী।
আওলাদ জামাকাপড় ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে এসে দেখে তুলি গাল ফুলিয়ে বসে আছে। আওলাদ এগিয়ে এসে হাঁটু গেঁড়ে তুলির মুখোমুখি হলো। তারপর বলল,
“বাবাটা সারাদিন অনেক কাজ করেছে আজ। তুলিকে নিয়ে কালকে একটা নয়, দুইটা নতুন জামা কিনে দেব।”
এই কথা শোনার পরও তুলির মুখে হাসি ফুটেনি। তখন রাজিয়া বলল,
“আজ তুলির জন্মদিন। সকালে তুমি বের হওয়ার সময় পেছন পেছন গিয়ে বলে এসেছে নতুন জামা আর জন্মদিনের কেক আনার জন্য। কোনোটাই তো আনলে না।”
আওলাদের মনে পড়ল। সকালে তাড়াতাড়ি বের হওয়ার সময় নতুন জামার কথা শুনলেও তুলির শেষাংশের কথা কান অবধি পৌঁছায়নি। এখন বাসা থেকে বের হতে ইচ্ছে করছে না। মাথার যন্ত্রনা কমেনি এখনও। সাথে শায়লা নামের মেয়েটির কথাটুকু বারবার একনাগারে কানের ভেতর বেজেই চলেছে। যেন ক্যাসেটের মধ্যে রেকর্ড করা একই কথা বারবার বাজে যাচ্ছে। আওলাদ বলল,
“ঠিক আছে তুলি, আমি আরেকটু পর গিয়ে তোমার জন্য কেক নিয়ে আসব। আর কালকে দুইটা নতুন জামা।”
তুলি গাল ফুলিয়ে বলল,
“ঠিক আছে, সরি বলো।”
আওলাদের যেন পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেছে। কেমন যন্ত্রনা যোগ হলো তার! সরি, সরি। যেদিকে যাচ্ছে সরি। আওলাদ হঠাৎ শোয়ার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। সেখান থেকে বের হলো টানা তিন ঘণ্টা পর। রাত অনেক হচ্ছে। মেয়েটার ঘুমানোর সময় হয়ে যাবে একটু পর। আশেপাশের কাউকে জানানো হয়নি তুলির জন্মদিনের কথা। এই দায়িত্বটুকু রাজিয়ার পালন করা দরকার ছিল। অন্তত দুয়েকদিন আগে থেকে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করা দরকার ছিল। অথচ সারাদিন শুধু টিভি সিরিয়াল দেখা রাজিয়ার কাজ। রাজিয়ার বাবা প্রচুর অর্থ সম্পত্তির মালিক। রাজিয়া সেই বাবার একমাত্র মেয়ে। আওলাদও বাবার একমাত্র সন্তান হওয়ায় বেশ টাকা-পয়সার মালিক। তবুও মনের ভেতর গোপন লোভ, রাজিয়া তার বাবার সব সম্পত্তি পাবে। এসব ভাবতে ভাবতেই পথে নামল আওলাদ। মাথার যন্ত্রনা কিছুটা কম মনে হচ্ছে এখন।
এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। আওলাদ এক সপ্তাহে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। মাথার যন্ত্রনা কিছুতেই কমছে না। ডাক্তার দেখানো হয়েছে দু’বার। কোনো উপকার হয়নি। ঠিকমত ঘুমাতে পারছে না আওলাদ। মনে হচ্ছে শায়লা মস্তিষ্কের একটা স্থান দখল করে বসতি গড়েছে। আর টেপ রেকর্ডার বাজিয়ে বারবার একই কথা বলে যাচ্ছে,
“আঙ্কেল, সরি বলুন।”
দুপুরের ভাত ঘুম দিচ্ছে তুলি। তুলির একপাশে আওলাদ, অন্যপাশে রাজিয়া শুয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে মোবাইলে কিছু একটা দেখছে। আওলাদ মেয়ের পিঠে হাত দিতে গিয়ে অজানা কারণে হাতটা সরিয়ে ফেলল। যেন ভীড়ের চিপা থেকে হাত সরানো হলো। আওলাদ নিচু স্বরে রাজিয়ার কাছে জানতে চাইলো,
“না ঘুমিয়ে কী দেখো মোবাইলে?”
উত্তরে রাজিয়া বলল,
“নাটক দেখি। আরেকটু বাকি আছে। ‘সরি দ্বিপান্বীতা’ নাটকটি এতবার দেখেও মন ভরে না।’
আওলাদের মাথায় যেন কেউ হাতুড়ি দিয়ে পিটাচ্ছে। আওলাদ আর শুয়ে থাকতে পারল না। শোয়া থেকে উঠে পুরোনো ডায়রীটা বের করল। অনেকদিন কিছু লেখা হয় না। কী লিখবে আওলাদ? কিছু না ভেবেই কলম হাতে নিলো। কিন্তু আওলাদের মনে হচ্ছে হাতের শক্তি কমে যাচ্ছে। মনের অজান্তে ডায়রীতে কয়েকবার লিখল,
“সরি, সরি, সরি, আঙ্কেল সরি বলুন।”
হঠাৎ আর কিছুই লিখতে পারছে না আওলাদ। হাতের দুইটা আঙুল একদিকে বাঁকা হয়ে গেল। মুহূর্তে আওলাদ চিৎকার করে ডাকল,
“রাজিয়া, রাজিয়া। আমার হাতে শক্তি পাচ্ছি না।”
রাজিয়া শোয়া থেকে উঠে এলো। ঘটনা সত্যি। হাতের দুইটা আঙুল একদিকে বাঁকা হয়ে গেছে। রাজিয়া কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। আওলাদের হাতের কব্জি থেকে আঙুল অবধি কেমন শক্ত কাঠের মতো মনে হচ্ছে। ততক্ষণে তুলি উঠে গেছে ঘুম থেকে। রাজিয়া আওলাদকে ধরে তুলল। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে দ্রুত। পাশের বাসায় খবর দিলে হয়তো কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে। রাজিয়া ছুটল সেদিকে।
তুলি বিছানায় বসে আছে। আওলাদ দ্রুত রান্না ঘরে ঢুকল। বাম হাতে বটি নিলো। ডান হাতটা টেবিলের উপর রেখে কব্জি বরাবর দুইটা কোপ। কব্জি থেকে আঙুলসহ হাতের অংশ আলাদা হয়ে পড়ল মেঝেতে। রাজিয়া পাশের বাসা থেকে মানুষ এনে দেখে রান্না ঘরে রক্তারক্তি অবস্থা। রাজিয়া চিৎকার করল। আওলাদের চোখ যেন বন্ধ হয়ে আসছে। পাশের বাসার যে দুইজন এসেছিল, তারা আওলাদকে ধরাধরি করে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। আওলাদ বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছে। সেই কথা যেন আওলাদ একাই আবার শুনতে পাচ্ছে।
আওলাদ আবারও বলছে,
“একবার সরি বলাতে এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে না। তবুও আমি সরি শায়লা। শায়লা আমি সরি।”

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত



বিষয়: #  #


আর্কাইভ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)