শুক্রবার ● ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩
প্রথম পাতা » সাহিত্য রম্যগল্প » গল্প : #নীড় হারা পাখি
গল্প : #নীড় হারা পাখি
অর্ধ-উলঙ্গ অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছে একটা মেয়ে।সারা শরীরে অসংখ্য কামড় আর আঁচড়ের দাগ।কোমরের নিচ থেকে পুরোটা রক্তে মাখা।রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ।
রাত প্রায় বারোটার কাছাকাছি। সাধারণত এই সময় গাড়ি খুব কম পাওয়া যায়।সোডিয়ামের আলোয় একা একা হেঁটে আসছি।রাতে হাঁটতে আমার বেশ ভালোই লাগে।বিশেষ করে আমার অফিস আর বাসার মধ্যস্থলে ব্রীজের পাড় নামক একটা জায়গা আছে।জায়গাটা বেশ সুন্দর। দিনের বেলায় যতটা কোলাহল থাকে রাতে তার চেয়েও নিস্তব্ধ নিরব হয়ে যায়।ব্রীজের পাড়ে আসতেই লক্ষ করলাম,রাস্তার সাইডে কিছু একটা পড়ে আছে।আচমকাই দেখে একটু ভয় পেলাম।সাহস করে সামনে গিয়ে দেখি,মেয়েটা এই অবস্থায় পড়ে আছে।
বুঝতে পারলাম মেয়েটা কিছু মানুষ রুপী হিংস্র জানোয়ারের শিকার হয়েছে।ছিঁড়ে ফুঁড়ে খেয়ে অবশিষ্ট খোলস-টা রাস্তায় ফেলে গেছে।এ’আর নতুন কিছু নয়।প্রায় দিনই দেখি এখানে ওখানে কত মেয়ে ধ’র্ষিতা হচ্ছে।পত্রিকা কিংবা হেডলাইনে বড় অক্ষরে লেখা থাকে।কল্পনাও করিনি কোনদিন স’চোক্ষে দেখতে হবে।মানুষের মনুষ্যত হারিয়ে গেছে।বিকৃত হয়ে গেছে মস্তিষ্ক।হিংস্র প্রাণীর চাইতেও নিকৃষ্ট। যাজ্ঞে সে কথা বলে লাভ নেই কোন।
মেয়েটা অজ্ঞান তবে দেহে প্রাণ আছে,শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে।ইমিডিয়েটলি হাসপাতালে নেওয়া দরকার।কিন্তু এত রাতে গাড়ি কোথায় পাবো?তাছাড়া মেয়েটার শরীরে তো কাপড় বলতেও কিচ্ছু নেই।
পড়নের টি’শার্ট-টা খুলে পরিয়ে দিলাম।কয়েক’টা গাড়িকে থামিয়ে বললাম,’মেয়েটাকে হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছে দিতে।’কিন্তু কেউই রাজি হলো না।নিজে বাঁচলে বাপের নাম।কে চায় কার জন্য বিপদে পড়তে।তাছাড়া মেয়েটা ধ’র্ষিতা পুলিশ কেস টেস হলে না জানি কোন জামেলায় পড়তে হয় কে জানে?হাত জোর করে অনুরোধ করলাম তাতেও কোন কাজ হলো না।
মেয়েটার অবস্থা ক্রমশই খারাপ হতে চলেছে।এভাবে রক্তক্ষরণ হতে থাকলে একসময় রক্তশূন্যতায় মারা যাবে। কিন্তু কী করবো বুঝে উঠতে পারছিনা।আমার আবার মস্তিষ্ক খুবই দুর্বল। এরকম পরিস্থিতিতে পড়লে মাথা একদমই কাজ করে না।নায়ক হলে হয়তো কোলে তুলে দৌড়ে হাসপাতালে নিয়ে যেতাম।কিন্তু এটা সিনেমা নয়, ইচ্ছা করলেই সুপার ম্যান হওয়া যায় না।বাস্তবতা বড়ই কঠিন।
অনেক কষ্টে একটা ভ্যান গাড়ির ব্যবস্থা করলাম।মানুষ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে জানে।সুযোগ বুঝে কায়দা করে।ভ্যান ওয়ালাও তেমন একজন মানুষ।সুযোগ পেয়ে এক টাকার ভাড়া পাঁচটাকা।বিপদে থেকে উদ্ধার হবার জন্য মানুষ কত কী না করে!সর্বসময় বিলিয়ে দিতেও রাজি।যাজ্ঞে,দুঃসময় পেয়েছি যে এটাও বেশি।
চাচাকে নিয়ে মেয়েটাকে ভ্যানে তুলে হাসপাতালে রওনা দিলাম।চোখের সামনে একটা মানুষ মারা যাবে আমি তা চেয়ে চেয়ে দেখতো কখনো হতে পারে না।যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করে যাবো।আজ যেনো রাস্তাটাও দীর্ঘ হয়ে গেছে।এই যে বলে না,বিপদের রাত ফুরায় না।একটু পর পর চাচাকে বলছি,’একটু জোড়ে চালাতে।কিন্তু যতই এগুচ্ছি ভ্যানের গতি ততই কমে আসছে।ভ্যান ওয়ালা চাচা বৃদ্ধ মানুষ।শরীরে শক্তি কতটুকুই বা আছে।এই বয়সে তার ঘরে বসে বিশ্রাম করার কথা।হয়তো!পরিস্থিতি বাধ্য করেছে তাকে।কিন্তু আমার কাছে এত সময় নেই।চাচাকে নামিয়ে মেয়েটার পাশে বসিয়ে নিজেই চালাতে শুরু করলাম।জীবনের প্রথম ভ্যান চালাচ্ছি,কষ্ট হচ্ছে খুব।তবে একটু হলেও তো সময় বাঁচবে এছাড়া উপায় নেই যে কোন।
.
রাত একটা বেজে পনেরো মিনিট,
অনেক কষ্টে একটা হাসপাতালে এসে পৌছালাম।এখনো মেয়েটার রক্তক্ষরণ হচ্ছে। রক্তে ভিজে গেছে ভ্যান গাড়িটা।জ্ঞান ফিরেনি এখনো।
ভ্যানওয়ালা চাচাকে নিয়ে মেয়েটাকে ইমারজেন্সিতে নিয়ে গেলাম।ভাড়া মিটিয়ে ভ্যান ওয়ালাকে বিদায় দিলাম।মেয়েটাকে ভর্তি করালাম।বিপদ যখন আসে চারদিক থেকেই আসে,একটার পর একটা।
এখানে আরেক সমস্যায় পড়লাম।ডাক্তার-রা মেয়েটার চিকিৎসা করছেনা।আগে পুলিশে রিপোর্ট করে আসতে হবে তার পর চিকিৎসা করবে।যেহেতু রেপিং এর ব্যাপার যদি কিচ্ছু হয়ে যায় তার দায়ভার কে নিবে?তারা কোন জামেলাই জড়াতে চান না।
অনেক করে বুঝিয়ে বললাম,’এই মুহুর্তে থানা পুলিশ করা সম্ভব নয়।তাছাড়া মেয়েটার অবস্থা খুবই সিরিয়াস।আর কিছুক্ষণ এভাবে থাকলে হয়তো মারাও যেতে পারে।আপনারা চিকিৎসা শুরু করেন,তারপর যা যা লাগে আমি সবই করবো।কিন্তু উনারা নাছোরবান্দা, এরা ডাক্তার নাকি কসাই,চোখের সামনে চিকিৎসার অভাবে একটা মানুষ মারা যাচ্ছে আর তারা নিজ চিন্তায় ব্যস্ত।
মেজাজ তিরিক্ষে উঠে গেছে।এক কথা দুই’কথায় ডাক্তারের সাথে ঝগড়া লেগে গেছে।ঠিক এমন সময় কেউ পিছন থেকে বলে উঠলো,
– ‘কী ব্যাপার আপনারা এখানে ঝগড়া করছেন কেনো?আরে আলম তুমি এখানে,কোন সমস্যা হয়েছে কী?’
পিছন ঘুরে তাকাই দেখি ডাক্তার মাহবুব হাসান।আমার খুবই পরিচিত,বেশ ভালো মনের একজন মানুষ।উনাকে পেয়ে মনে একটু ভরসা পেলাম।’মাহবুব হাসান’ ভাইকে সব খুলে বললাম।উনি মেয়েটার অবস্থা দেখে উপস্থিত ডাক্তাদের প্রতি খুবই রাগান্বিত হলেন,এবং তারাতারি মেয়েটার চিকিৎসা শুরু করতে বললেন।
মেয়েটার চিকিৎসা শুরু হয়।আমি ICU এর বাহিরে দাঁড়িয়ে ‘আল্লাহ্ আল্লাহ্’ করছি।কিছুক্ষণ পর ‘মাহবুব’ ভাই বের হয়ে আসলেন।আমাকে ডেকে নিয়ে তার কেবিনে গেলেন।
– “ জীবনে অনেক ধ’র্ষিতা মেয়ের চিকিৎসা করেছি।কিন্তু এত নিষ্টুরতা বর্বরতা আর দেখিনি।একে তো মেয়েটা ভা’র্জিন তার উপর পিরিয়ড চলছিলো।
অবিবাহিতা একটা মেয়ের পিরিয়ডের যন্ত্রণা সহ্য করতে প্রাণ যায় যায়।এমন অবস্থায় কয়েকজন মিলে ঘন্টা দু’এক নাগাড়ে ধ’র্ষণ করা হয়েছে যৌ’না’ঙ্গ ছিঁড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে।কীভাবে কী করবো বুঝে উঠতে পারছিনা।কিছুতেই রক্ত বন্ধ হচ্ছে না। ”
‘মাহবুব’ ভাইয়ের চোখ ছলছল করছে।ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ।আমি ‘মাহবুব’ ভাইকে বললাম,
– ‘যে করেই হোক মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে।প্রয়োজনে যা যা দরকার তাই করবেন।সবকিছু আমি দেখবো।’
‘মাহবুব’ ভাই বললেন,
– ‘আমরা আমাদের যথাসম্ভব চেষ্টা করছি বাকিটা আল্লাহর হাতে।এই মুহুর্তে মেয়েটার শরীর প্রায় রক্ত শূন্য।ইমিডিয়েটলি ‘ও’ নেগেটিভ রক্ত দরকার।আমাদের হাসপাতালে নেই তুমি যে করেই হোক তাড়াতাড়ি রক্তের ব্যবস্থা করো।নইলে মেয়েটাকে বাঁচানো সম্ভব হবে না।’
.
রাত দুইটা পেরিয়ে গেছে,
এত রাতে রক্ত পাবো কোথায়।এ’সময় ব্লাড ব্যাংক ও তো সব বন্ধ।আমার জানা শোনা তেমন কোন ডোনারও নেই।তাছাড়া আমার কাছে তেমন টাকাও নেই।কী করবো ঠিক বুঝতে পারছিনা।কঠিন জামেলায় জড়িয়ে ফেলেছি নিজেকে।তবে উপায় একটা আছে।আমার রক্তের গ্রুপ ‘ও’ নেগেটিভ।
ডাক্তার-কে আমার শরীর থেকে রক্ত নিতে বললাম।আমি এমনিতেই খুব হ্যাংলা পাতলা মানুষ।রুগ্ন চিলেকোঠা।আমার থেকে রক্ত নিতে রাজি হচ্ছিলো না।কিন্তু এছাড়া কোন উপায় নেই।যে করেই হোক মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে।নাহলে যে সব ব্যর্থ হবে।মেয়েটা কে?কী তার পরিচয়?আর কারাই বা তার এমন অবস্থা করেছে সবকিছুই যে অজানা থেকে যাবে?
.
রক্ত দিয়ে বেরোলাম, খুব ক্লান্ত লাগছে।পেটের মধ্যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।সেই দুপুরে খেয়েছিলাম,এখন রাত আড়াইটা বাজে।ক্ষুদার ঠেলায় দুচোখ অন্ধকার হয়ে এসেছে।পকেট খুঁজে ৬০ টাকা বেরুলো।এতে আর কী খাবো।
হাসপাতাল ক্যান্টিনে আসলাম।এক কাপ চায়ের সাথে একটা পাউরুটি ভিজিয়ে খেয়ে নিলাম।পুরোনো অভ্যেস,বাঁচার কী নিদারুণ প্রয়াস। সিগারেট-টা ধরিয়ে একের পর এক সুক্ষ্ম টান দিয়ে যাচ্ছি।সিগারেট খেলে নাকি টেনশন কমে,ডাহামিথ্যে কথা!!
সারা দুনিয়ার চিন্তা যেনো আমার মস্তিষ্কে বিচরণ করছে।ভালো লাগছেনা কিছু।তাড়াতাড়ি চলে আসলাম।ICU এর সামনে এসে দেখি…..
…
গল্প : #নীড় হারা পাখি
লেখা : #মোহাম্মদ আলম সরকার
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত
বিষয়: #গল্প #নীড় #পাখি #হারা