শুক্রবার ● ১ ডিসেম্বর ২০২৩
প্রথম পাতা » বিশেষ সংবাদ » জিপিএ ৫ পেয়েও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি অনিশ্চিত!
জিপিএ ৫ পেয়েও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি অনিশ্চিত!
২০২৩ সালের উচ্চমাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে গত রবিবার (২৬ নভেম্বর)। এবার এই পরীক্ষায় গড় পাসের হার ছিল ৭৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। আর জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৯২ হাজার ৫৯৫ জন। এসব শিক্ষার্থীর অধিকাংশেরই আবার প্রথম লক্ষ্য থাকবে স্বনামধন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া।
কিন্তু পাবলিকে যে আসন আছে তার অনেক বেশি শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েছেন। ফলে অনেক শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েও তার কাঙ্ক্ষিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারবেন না। আর যারা ভর্তি হবেন তাদেরও কঠিন ভর্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে নিজেকে সুযোগ করে নিতে হবে। দিন কয়েক পরে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ভর্তিযুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে। আর এই লক্ষ্যে শিক্ষার্থীরা এখন শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, চলতি বছর ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডে ৭৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ,দিনাজপুর বোর্ডের ৭০ দশমিক ৪৪ শতাংশ,সিলেট বোর্ডের ৭৩ দশমিক ০৭ শতাংশ, ময়মনসিংহ বোর্ডের ৭০ দশমিক ৪৪ শতাংশ, চট্টগ্রাম বোর্ডের ৭৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ, যশোর বোর্ডের ৬৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ,মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে আলিম পরীক্ষায় ৯০ দশমিক ৭৫ শতাংশ, বিএম-ভোকেশোনাল পরীক্ষায় কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ৯১ দশমিক ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছেন। সব শিক্ষাবোর্ড মিলিয়ে এবার এইচএসসি পরীক্ষায় মোট পাস করেছেন ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৮৫২ জন পরীক্ষার্থী। এছাড়া এবার দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডে পরীক্ষায় অংশ নেওয়া সাড়ে ১৩ লাখের বেশি শিক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৯২ হাজার ৫৯৫ জন।
আরও জানা যায়, উচ্চশিক্ষার জন্য সরকারি বেসরকারিসহ বিভিন্ন জায়গায় আসন রয়েছে ১৩ লাখের মতো। তবে এক্ষেত্রে মেধাবীসহ অধিকাংশ শিক্ষার্থীর নজর থাকে স্বনামধন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কিন্তু সেখানে আসন রয়েছে অনেক কম। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০ হাজার ৮৮৬টি আসন আছে। সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৩ হাজার, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ লাখ, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮৭ হাজার ৫৯৩ এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ লাখের মতো আসন রয়েছে বলে অভিমত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসির)। ফলে ৪১ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েও ভর্তির সুযোগ পাবেন না।
এক্ষেত্রে শুধু জিপিএ ৫ ধারীরা সুযোগ পাবেন বিষয়টি এমন নয়। ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করে অনেকে জিপিএ ৫ না পেয়েও ভর্তির সুযোগ পান। ফলে উচ্চ মাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীরাও ভর্তিবঞ্চিত হওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন। এক্ষেত্রে মধ্যম মানের শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষায় যত ভালো করবে, জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের বাদ পড়ার সংখ্যা ততই বাড়বে।
পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষায় অনেক জিপিএ ৫ ধারী শিক্ষার্থীর ঝড়ে পাওয়ার অসংখ্যা নজির রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ভর্তি অফিস থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ছয় বছরে কোনোবারই ২০ শতাংশ কিংবা তার বেশি শিক্ষার্থী পাস করতে পারেনি। অর্থাৎ প্রতিবছরই ৮০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী ফেল করে ঢাবি ভর্তি পরীক্ষায়। ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ক, খ, গ, ঘ এবং চ মোট ৫ ইউনিটে অংশগ্রহণ করে ২ লাখ ৬৮ হাজার ৬০৫ জন শিক্ষার্থী। এরমধ্যে সম্মিলিতভাবে পাস করে ২৭ হাজার ৪৮৮ জন পরীক্ষার্থী। যা শতকরায় ১০ দশমিক ৭৯ শতাংশ। অপরদিকে এই শিক্ষাবর্ষে অর্থাৎ ২০২১ এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছিল ১ লাখ ৮৯ হাজার ১৬৯ জন। অর্থাৎ জিপিএ ৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর ৬ ভাগের এক ভাগ শিক্ষার্থীও পাস করতে পারেনি।
নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থী আলমগীর হোসাইন ২০২৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ ৫ পেয়েছেন। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি বিবার্তাকে বলেন, যদিও আমি জিপিএ ৫ পেয়েছি তারপরেও মনে ভয় কাজ করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় পাস করতে পারি কি-না? কারণ অনেকে জিপিএ ৫ পেয়েও কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকে না। আর এই সংখাও নেহায়াত-ই কম নয়। তবে আমি আমার সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিচ্ছি। বাকীটা আল্লাহ ভরসা।
চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন আবু সাঈদ শপন। তিনি বিবার্তাকে বলেন, আমি এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাইনি। ফলে এই ধাক্কাটা আমি ভর্তি পরীক্ষায় ভালো মার্ক পাওয়ার মধ্য দিয়ে কাটিয়ে উঠতে চায়। আমার মতো অনেকে জিপিএ ৫ না পেয়েও ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। আমি তাদের থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে তাদের একজন হতে চায়।
জিপিএ ৫ পেয়েও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে অনিশ্চয়তার বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বিবার্তাকে বলেন, কোনো দেশেই উচ্চশিক্ষায় ভর্তির আসন সীমাহীন হয় না। এ ছাড়া উচ্চশিক্ষা সবার জন্য নয়। সমাজে সব ধরনের পেশার প্রয়োজন আছে। সেদিকটি মাথায় রেখে শিক্ষার্থীরা তাদের পরিকল্পনা তৈরি করতে পারে।
তিনি বলেন, ভর্তির ক্ষেত্রে যে সংকটের কথা বলা হচ্ছে, সেটি তৈরি হয়েছে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে পার্থক্যের কারণে। মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের খুবই সংকট আছে। এমনকি বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ও একই মান নিশ্চিত করতে পারে না। যদি বাধ্যতামূলকভাবে বিভিন্ন প্রোগ্রামের স্বীকৃতির (অ্যাক্রেডিটেশন) ব্যবস্থা করা হয় তবে মানসম্মত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়বে।
তিনি আরো বলেন, পছন্দের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিষয়ে ভর্তিতে তীব্র প্রতিযোগিতা হবে। জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭০ শতাংশ তাদের প্রথম পছন্দের প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারবেন। বাকি ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী তাদের দ্বিতীয় পছন্দের প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাবেন।
এই প্রসঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বিবার্তাকে বলেন, জিপিএ-৫ বিষয়টি বেশি আলোচিত মিডিয়া ও অভিভাবকদের কারণে। এটা একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞানের একমাত্র যোগ্যতা হতে পারে না। দেখা গেল, আগে যারা ৬০ শতাংশ মার্ক পেয়ে ফার্স্ট ক্লাস পেত, তারা এখন ৮০ শতাংশ মার্ক পেয়ে জিপিএ-৫ পাচ্ছে। আগে একটা প্রশ্নের উত্তরে ১০ এ ৬ দেওয়া হলেও এখন কিন্তু অবলীলায় ৮ দেয়া হচ্ছে। মোটকথা, জিপিএ-৫ দিয়ে তেমন কিছু যায় আসে না।
জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারার বিষয়ে তিনি বলেন, জিপিএ-৫ এর চেয়ে আসন কম থাকলে এটা তো হবেই। আমি মনে করি, শিক্ষার্থীরা যে যেখানে পড়ুক, তাদের প্রকৃত শিক্ষাটা গ্রহণ করার চেষ্টা করতে হবে।
জিপিএ ৫ কেন্দ্রিক পড়াশোনা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বিবার্তাকে বলেন,আজকে আমরা সব ছাত্রছাত্রীকে নম্বরের দিকে ধাবিত করছি, জিপিএ ৫ পাওয়ার দিকে ধাবিত করছি। এ কাজটা শিক্ষকরা করছে, অভিভাবকরা করছে, সমাজ থেকেও করছে। এমনকি সমাজে একজন শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করা হয়, তুমি জিপিএ কত পেলে? এই জিপিএ দিয়ে তাকে মূল্যায়ন করা হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীকে সঠিকভাবে শিখানো হয়েছে কিনা, সে শিখতে পেরেছে কিনা এই বিষয়গুলোর আলোচনা হচ্ছে না।
তিনি বলেন, জিপিএ ৫ এর যে প্রতিযোগিতা সেই প্রতিযোগিতা থেকে ছেলেমেয়েদের ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদেরকে বিদ্যা অর্জনের দিকে ধাবিত করতে হবে। তারা কতটুকু শিখলো, সেই বিষয়টির গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই লক্ষ্যে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছেন, বেশ কিছু সিদ্ধান্তও নেয়া হয়েছে।
এই শিক্ষাবিদ বলেন,ছাত্র-ছাত্রীদের বইয়ের দিকে নিয়ে আসতে হবে। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার্থী নয় বরং জ্ঞান অন্বেষণকারী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। পরীক্ষাটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, একটা পরীক্ষা দিয়ে হয়তো আমরা মূল্যায়ন করি। তবে পরীক্ষার মধ্যে শুধু শ্রেণিকক্ষের কারিকুলাম থাকবে এটা নয়, এখানেই শিক্ষার্থীর সাংস্কৃতিক চর্চা, খেলাধুলা, আচার-আচরণ, সৌজন্যবোধসহ সার্বিক বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এই সবগুলো বিষয়ের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করলে ভালো ফলাফল আসবে বলে আশা করা যায়। বিবার্তা
বিষয়: #অনিশ্চিত #জিপিএ #পাবলিক #বিশ্ববিদ্যালয় #ভর্তি